Skip to main content

Full text of "Rupmoti"

See other formats


লু লপামতী 





নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় 


বন্থ সাহিত্য সংসদ 


১০, খ্যামাচরণ দে স্্বীট, কলিকাতা-১২ | 


প্রথম প্রকাশ 
ভাঙ্ু, ১৩৬৬ 


প্রকাশক 
অমিয় বসু 
১০, শ্যামাচরণ দে পরী, 
কলিকাত1-১২ 


প্রচ্ছদ পরিকলনা 
বোধ দাশগুঞ্ 
মুদ্রক 
এণকুক্ পাল 
ভীশশী প্রেস 
৪৫, অস্জিদবাড়ী স্্রীট, কলিকাতা-৬ 


জাম ২৫০ 


€,5(৮-৮ 
6972০ 2শাাি জা, |. ১৭ 
সরা 5 গত বে ০৫ 
৩৮8 07775 
৯১৫ ৯৫০ ৬৮৩১ ০ 


কবি হক্সগ্রসাদ মিক্র 


ছাক্াসক্গিনী, নীলক, 
বাড়ী বদল, খেলনা, ক্ষত, 


আজ্ঞ্যেভি, 
কবাতজি 


এই তল্খখব্কেক্স ককস্সেকখ্বান্নি বক 
উপনিবেশ € ভিন এগ ১ 
্বর্শসীব্তা। 
স্র্ধয সারি 
শিলালিপি 
লালমাটি 
সধ্শারিনী 
মহানন্দা 
০্রভগল 
স্ব-লিবাঁটিত্ত লাক্ 
অআনিধাক। 
€ম্ঘলাগ 
সধপেজ মাখা আমি 
স্বাহিত্যে তা গল্প 


চান 00 : 
শি 18887 
রে 


তু 
204 
ছায়া স্িনী 

সব কথা আব্গকে আমি খুলে বলব। নইলে আর জ্মান্ি 
সময় পাব ন।। 

ভারী আশ্চর্য লাগছে একটা জিনিস ভাবতে । এতদিন সবাই 
আমাকে দেখেছে-_রুপো রঙের আলোয় কত মানুষের মুগ্ধ চোখের 
সামনে ঝলমলিয়ে উঠেছি আমি । অথচ, আমার অস্তিত্ব যে কোথাও 
আছে কেউ সে-খবর জানত না। যখন চলে যাব তখনও রে জানবে 
না আমি কোনোদিন ছিলুম | 

বোধহয় হেঁয়ালির মতে! ঠেকছে । এবার সব স্পষ্ট করেই বলৰ। 
কিছু আর আড়াল রাখব না। * এতদ্রিন আড়ালে আড়ালেই তে। 
ছিলুম। অনস্তিত্বের এই ছদ্মবেশের অন্তরালে এখন আমার দম 
বন্ধ হয়ে আসছে। যে না-থাকার অভিনয় এতদিন ধরে করে 
আসছি, এইবারে সেইটেকেই সত্য করে তুলব। 

আবরণ তবে সরেই যাক । 


আমি ব্রাহ্মণ-পগ্ডিতের ঘরের মেয়ে। ঠাকুর টোল ছিল-_ 
ছেলেবেলার স্মতির ভেতরে সে-দসব এখনো আবছা হয়ে আছে। 
এখনে স্বপ্ধের মতো! মনে পড়ে শামুকের খোলা-ভতি নস্তি নিয়ে 
ঠাকুর্দ! ছাত্রদের পড়াতে বসেছেন--চিৎকার করে কী যেন বোঝাতে 
চাইছেন আর মাথা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকিতে বাধা একট! ছবাফুল 
এদিক-ও1 ক দোল খাচ্ছে। 

কালের হাওয়ায় বাব। স্কুলে-কলেজে পড়লেন । অফিসে চাকরি 
নিলেন । কিন্ত সংস্কৃত চ্গার অভ্যাষ তার গেল ন1। বাড়িতে 
নিজে সংস্কৃত পড়তেন, বাংলা পুরাণ পড়তেন- আমাদেন্লও পড়াতেন ! 
আমর] ছু ভাই--ছ্‌' বোন £ চারছ্ধনের মধ্যে আমি তৃতীয়। 


রঙ ৫ 


ভাইয়েরা স্কুলে গেল-_কলেজেও গেল তার পরে। কেবল 
আমাদের ছঃবোনের ব্যাপারেই অদ্ভুত রকমের রক্ষণশীলতার 
পরিচয় দিলেন বাবা । আমাদের স্কুলে যেতে দিলেন না । বাড়িতে 
বসেই আমি সংস্কৃতের গোটা ছুই পাশ করে ফেললুম। আর 
শিখলুম সীতা-সাবিত্রী হওয়ার নিভু শাস্ত্রীয় পন্থা! । 
ফস্কা গেরে। ছিল ওইখানেই । 
সিনেমায় আমরা যেতে পেতৃম বই কি। তবে বাছ! বাছা বই 
ছিল। ধর্মমূলক, পৌরাণিক, উপদেশপুর্ণ। একদিন ওইরকম একটা! 
কী ছবি দেখতে গিয়েই আমার প্রথম আত্মদর্শন হল। 
আমার বয়েস তখন পনেরো । বাবার শাস্ত্রীয় শাসনে আর কিছু না 
হোক-_উজ্জল পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যে আমার শরীর ভরে উঠেছিল। তা ছাড়া 
লম্বাটে গড়নের জন্যেও বয়েসের চাইতে আমাকে বেশ বড়ই দেখাত। 
আমরা ছু” বোন ছৰি দেখতে গিয়েছিলুম দূর-সম্পর্কের এক 
দাদার সঙ্গে। বাবা তাকে খুব বিশ্বাস করতেন । আজকে তার 
পুরো! নামটা! আর বলবার দরকার নেই, ভাক-নাম মন্তুদাই বলি। 
তখন ইনণ্টারভ্যালের আলে! জ্বলেছে, মন্দা বাইরে গেছে পান 
খেতে । আমরা ছু" বোন চুপ করে বসে আছি-_হঠাৎ একটা কথ! 
কানে উড়ে এল। 
গ্যাখ. গ্যাখ-_তাকিয়ে গ্াখ, ওদিকে__ 
মেয়েদের সহজ সংস্কারে আমর] টের পাই। অনেক দূরে লুকিয়ে 
বসে পেছন থেকে কেউ চোর! চাউনি ফেললেও তা আমাদের অন্ু- 
ভূতিতে সাড়া জাগায়। বুঝতে পাঁরলুম আমাদের লক্ষ্য করেই 
বল। হচ্ছে। 
তাকিয়ে দেখলুম সামনের দিকে গুটিকয়েক ছোকরা । কলেজের 
ছাত্র হওয়াই সম্ভব । তাদের দৃষ্টি ঘুরে আছে আমাদের দিকে-_ 
বিশেষ করে আমারই মুখের ওপর । একজন বলছে, ওই লাল- 
শাঁড়িপর1 মেয়েটিকে দেখেছিস রে? প্রায় অবিকল এক চেহার]1 | 
হঠাৎ দেখলে মনে হয়- মিতালী দেবী বসে রয়েছে। 


উর 


শুনে আমার মুখ রাত হয়ে গেল। “কিন্ত আমার ছোট' বোন 

বারে! বছরের খুকু হেসে উঠল খিল্খিলিয়ে । ৃ 

আমি ধমক দিয়ে বললুম, কী হাসছিস তুই অসভ্যের মতো ! 

খুকু হাসি বন্ধ করলে, কিন্তু চোখছুটো৷ ওর চকচক করতে 
লাগল। চাপা গলায় বললে, ওরা কিন্তু ঠিকই বলেছে দিদি। 
হঠাং তোকে দেখলে মিতালী দেবীই মনে হয় ! 

আমি আরও লাল হয়ে বললুম, ছিঃ_চুপ কর । 

আলো! নিভে এল। ছবিআরম্ত হবে আবার । পান চিবুতে 
চিবুতে নিজের জায়গায় ফিরল মনুদা। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস 
ফেললুম । ূ 

কিন্ত তার পরে ছবিতে আমার আর মন বসল না। রক্তের মধ্যে 
কোথা থেকে ছোট একটা ঢেউ উঠে পড়ল। আমার এই পনেরে। 
বয়েসের মধ্যে অনেক সংস্কৃত বই পড়েছি আমি-_-নিজের ছোট এই 
জীবনটুকুর ভেতরে ছোট বড় অনেক দোলা লেগেছে অনেকবার । 
কিন্ত এযে আজ কীহল আমি কিছুতেই বুঝতে পারলুম না । 
একটা আশ্চর্য উত্তেজনায় আমার হৃৎপিণ্ড কাপতে লাগল-_-মনে 
হতে লাগল চাঁপা জ্বরের উত্তাপ ফুটে উঠছে শরীরে | 

ছবি দেখে রাস্তায় বেরিয়ে অন্যমনস্কের মতো চলেছি, হঠাৎ 
উচ্ছৃসিত হয়ে খুকু বললে, জানো মনুদাঁ-কী একটা মজা হয়েছে 
আজকে ? 

কিসের মজা রে? 

জানো, দিদিকে দেখে কয়েকটা ছেলে বলছিল-_ 

আমি রাগ করে বললুম, চুপ কর, বাদর মেয়ে। 

খুকু বললে, বারে, দোষের কথা তো কিছু বলেনি। ওরা 
বলছিল, দিদি নাকি ঠিক ফিলস্টার মিতালী দেবীর মতে! দেখতে। 

আমি আরও রাগ করে বললুম, ছাই। 

মন্দা একবারের জন্তে থেমে দীড়ালো- হুট চোখ সম্পূর্ণ 
করে মেলে ধরল আমার দিকে । তখন আমার মুখের ওপর পথের 


৯৬. 


ইলেক্টি ক লাইট আর আকাশের জ্যোৎস়া একসঙ্গে খানিক অন্ভুত 
আলো ফেলেছিল। সেই আলোর মায়ায় আর আমার পরেরে। 
বছরের লাবণ্যে মন্তুদাও বোধহয় আমাকে নতুন করে দেখল । 

অন্তু ধরাগলায় মন্ুদা বললে, খুব অন্তায় বলে নি কিন্তু। 

খুকু আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল । 

কেমন, দেখলি তো দিদি? 

আমি- ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের মেয়ে সেই অহমিকা আমার ভেতরে 
ফণ। তুলল । বললুম, এ-সব যা-তা বোলো! না মনুদা। শুনলেও 
অপমাল হয়। ৃ্‌ 

অল্প একটু হেসে মন্দা! বললে, আমার ওপর রাগ কর! মিথ্যে। 
দোষ তাকেই দে টুন্ব-_যে তোদের ছু'জনকে একই ছণাচে ঢেলে তৈরি 
করেছে! 

আমি জবাব দিলুম না। হনহুন করে আগে আগে হাটতে আরস্ত 
করলুম। টের পাঁচ্ছিলুম, যতট। জোরে হাটছি__সে-তুলনায় হাপাচ্ছি 
অনেক বেশি। 

পথে আর বিশেষ কোনে কথ হল না। শুধু বাড়িতে ঢোকার 
মুখে খুকুকে শাসিয়ে বললুম, একথা যদি আর কাউকে বলবি, তা 
হুলে গলা টিপে দেব তোর । 

খুকু ঘাড় নেড়ে বললে, আচ্ছা! । 

কিন্ত খুকুকে শাসন করলেও নিজের মনের গলা তো টিপে বন্ধ 
করতে পারি না। সারারাত আমি ঘুমুতে পারলুম না। আমার 
রক্তে যন্ত্রণার মতো। কী যেন খেলে বেড়াতে লাগল । আমার চেহার! 
অবিকল একজন ফিল্স্টারের মতো! দেখতে ! আমাকে দেখে 
লোকে মিতালী দেবী বলে ভূল করতে পারে । ছিঃ ছিং! মহা 
মহোপাধ্যায বংশের মেয়ে আমি-_এ লজ্জা রাখব কোথায় । 

অথচ, শুধুই কি লজ্জা! তার সঙ্গে কোথায় যেন একটা সুখ 
মিশে আছে- নেশা"জড়ানো একটা উত্তেজনা লুকিয়ে আছে 
কোথাও। আচ্ছাঃ আমি যদি সত্যিই মিতালী দেবীর মতে। নামকরা! 


৯৪ 


ফিলান্টার হতুম--কী হত তাহলে? মিতালী দেবীর এত নাঁম--- 
কাঁগজে কাগজে তার ছবি, শুনেছি, অনেক টাকাও সে রোজগার 
করে। সেকিখ্ুবসুখী? 

তার পরেই নিজেকে আমি তীব্রতম ধিক্কার দিলুম । আমি মহা- 
মহোপাধ্যায় বংশের মেয়ে--কিছুদিন পরে উপাধি পরীক্ষা দিয়ে 
“সরত্বতী” হব--এ"সব আমি কীভাবছি! ফিলের মেয়েরা যে কত 
খারাপ--সে কথ! কতজনের মুখে কতবারই তো শুনেছি। শেষ 
পর্যস্ত আমি কিনা-- 

বিছান। ছেড়ে উঠে এলুম। জানালার ঠিক সামনেই সপ্তষি। 
পনেরো বছরের স্বচ্ছ সহজ দৃষ্টিতে আমি দেখলুম বশিষ্ঠের পাশেই 
অরুদ্ধতীর সতী-প্রদীপ জ্বলছে--ঞ্রবলোক থেকে তিমিরগহন পান 
হয়ে আমার মাথার ওপর আলোকের কণায় কণায় ঝরছে শুচিশ্মিত 
আনীর্বাদ। আমি মহিয় স্তভোত্র উচ্চারণ করতে লাগলুম নিঃশব্দে 

দিন কয়েক ভালোই কাটল। ঠিক করঙ্গুম, আর সিনেমায় যাৰ 
না। মনের ভেতরে যে ছোট্ট টেউটা উঠেছিল, ধীরে ধীরে তা মিলিয়ে 
এল একদিন । 

কিন্তু সিনেমায় যাঁওয়ারও দরকার হল না। 

আমাদের বাড়ি থেকে গঙ্গ খুব দূরে নয়। বাবার সঙ্গে ভোরে 
গঙ্গাল্সান করতে যাই রোজ । সেদিনও গিয়েছিলাম । 

ন্লান করে যখন ফিরছি-_তখন সামনে লাল হয়ে সুর্য উঠছিল । 
নিজেকে আমি দেখি নি-_-তবু জানতুম সেদিন আমাকে কেমন 
দেপাচ্ছিল। আমার পনেয়ো বছরের শাদাশাস্ত কপালে চন্দনের 
ফোটার ওপর সুর্যোদয়ের লাল আলো পড়ে অরুন্ধতীর সি'ছুরের 
মতো! মনে হচ্ছিল; আমার পরনের গরদের শাড়িটারও ছিল 
শ্বেতচন্দনের রঙ; আমার ছু'খানি পা যেন পথের ওপর লল্মীর 
পদলেখা একে দিচ্ছিল । 

ঠিক সেই সময়েই কে যেন কাকে বললে, ওই যেয়েটিকে 
দেখেছ? 


৯ 


বাবা একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন, শুনতে পেলেন না। কিন্তু 
শবভেদী বাণ এসে ঠিক আমার বুকে বিধল। কে বলছিল 
আমি জানি না-_তাকিয়েও দেখি নি--কিস্ত নিজের অজ্ঞাতেই আমার 
পা থমকে গ্লাড়ালো। 

সেই গল আবার বললে, হঠাৎ দেখলে কী মনে হয় বলে! তো? 

আর-একটি অলক্ষ্য স্বর বললে, ঠিক যেন “যৌবন-যমুনা” 
ছবিতে মিতালী দেবী । গঙ্গানান করে ফিরে আসছেন। 

আমার রক্তে এবার আর ছোট একটুখানি ভরঙ্গই জাগল না-_ 
হঠাৎ যেন ঝড় এসে আছড়ে পড়ল। আমি দ্রেত পায়ে নিজের 
বুকের শব্দ শুনতে শুনতে এগিয়ে চললুম। আকাশে তখনও 
ুর্যের লাল রঙ-_কিন্ত আমি টের পাচ্ছিলুম, আমার কপাল 
থেকে অরুদ্ধতীর সি'ছুর মুছে গেছে। 

সারাট। দিন যেন কিছুতেই আর মন বসতে চাইল না। বাবার 
কাছে পড়তে গিয়ে এমন একটা ছেলেমান্ুষি ভূল করে বসলুম 
যে বাবা আশ্চর্য হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন । 

দিন তবু একরকম গেল, রাতটাই অসহ্য। 

কপালের ছু'পাশে দপদ্প করতে লাগল-_চোঁখের পাতা যতই 
বন্ধ করতে চাই, ততই কে যেন তা জোর করে টেনে রাখল। 
আশপাশের বাড়ি থেকে, বাইরের পথ থেকে প্রত্যেকট। খু'টিনাটি 
শব্দ অন্বাভাবিক জোরালো হয়ে এসে আমার কানের পদণয় 
ঘা দিতে লাগল। আমি আবার জানলার পাশে এসে ধ্রাড়ালুম । 
কিন্তু আজ আর আকাশে সপ্তষি দেখা যাচ্ছিল না-_ফ্রুবতারাও 
নয়, একটা ছাইরঙ! ভূতুড়ে মেঘে ঢাকা পড়ে ছিল সব। 

সেইদিন থেকেই নিজের কাছে আমি হারতে আরম্ভ করলুম । 

জোর করেও ঠেকাতে পারলুম নাঁ-কিছুতেই না। আমার 
বই গেল, উপাধি পরীক্ষা! গেল, এতদিনের শিক্ষাদীক্ষা সব গেল। 
যে-মুহুর্তেই হাল ছেড়ে দিলুম, সেই থেকেই আর কোথাও এতটুকু 
সংশয় রইল না। বাবার চোখ এড়িয়ে, খবরের কাগজ আর 


৯৪ 


এখান-ওখাঁন থেকে মিতালী দেবীর ছবি যোগাড় করতে লাগলুম 
আর ঘরের দোর.বন্ধ করে দিয়ে আয়নার সামনে ধীাড়িয়ে মিলিয়ে 
দেখতুম আমাদের হু'জনের মিল কতখানি । আমার হালিতেও 
অমনি করে গালে টোল পড়ে কি না--আমি বিষণ হয়ে উঠলে 
আমার মুখেও অমনি ক্লান্ত বেদন! ছড়িয়ে পড়ে কি না, আমার 
চোখের তারাতেও অমনগ্ভাবে মনের আলে! ঝিকিয়ে ওঠে 
কিনা! 

শেষ পর্যস্ত অসহ্য হয়ে উঠল। মন্ুদাকে চুপিচুপি ছাদে ডেকে 
নিলুম । 

আমাকে মিতালী দেবীর ফিল্ম দেখাবে মন্দা ! 

মিনিটখানেক মনুদা চুপ করে চেয়ে রইল আমার দিকে । ওর 
মুখের ওপর কতগুলো! অদৃশ্য রেখা ফুটে উঠেছে বলে আমার 
মনে হল। 

মনুদ! বললে, মিতালী দেবী তো ধর্মমূলক ছবিতে নামে না । 

যাতে নামে তাই আমি দেখব। 

কিন্তু মামা তে! তোকে ষেতে দেবেন ন।। 

নিজের ওপর আমার তখন আর কতৃত্ব ছিল না। নিলজ্জে 
স্পষ্ট ভাষায় বললুম, তুমি ব্যবস্থা করে দাও । 

তার পরে শুরু হল মিথ্যার পালা । চিড়িয়াখানায় যাওয়ার 
নামে, মনুদাদের বাড়ি যাওয়ার নামে, বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্নের 
নামে । বাব! মনুদাকে বড় বেশি বিশ্বাস করতেন । 

আর আমি? মিথ্যার পথে একবার যখন পা দিলুম-_তখন 
আর ফেরবার পথ কোথায়? কখনো কখনো খারাপ লাগত না 
তা নয়-_কিস্ত সেই মুহুর্তেই হয়তো পর্দার ওপর মিতালী দেবীর 
ছবি ফুটে উঠত। এইমাত্র হয়তো! নায়ক ভার নীরব প্রেমকে 
উপেক্ষা করে নিষ্ঠুরের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে, আর 
অসহা যন্ত্রণায় বালিশে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে মিতালী । 
ান্প সেই যন্ত্রণা আমার হ্ৃংপিগুকেও যেন দলে-মুচড়ে একাকার 


১৫ 


করে দিত।। শাড়িয় আচলে মুখ ঢেকে আমিও প্রাপপণে কান্না 
চাপবার চেষ্টা করতৃ্ । 

আর তার মধ্যেও কানে আসত । 

আশ্চর্য ঠিক এক চেহারা ! 

যমজ বোন নয় তো? 


গযাখ, না! জিজ্ঞেস করে-_সত্যি বোন নাকি ? 
আমি ভাবতুম-বোন নয়, আমরা এক। কার যেন বিচিত্র 


খেয়ালে ছুটো আলাদা শরীরে ভাগ হয়ে গেছি আমরা । ওর 
হখ, ওর আনন্দ, ওর ভালোবাসা_সব আমার । রাত্রে চমকে 
উঠতুম এক-একদিন। আচমকা মনে হত, জানল! দিয়ে তরুণকুমার 
এসেছে আমার ঘরে, আমার কপালে তার হাত রেখে গভীর 
গলায় বলছে, আমায় ক্ষমা করো মাধবী । আমি তোমায় ফিরিয়ে 
নিতে এসেছি । আর অভিমান করে থেকো না-_এসো আমার সঙ্গে ৷ 

শুধু একটা কথা কোনোদিন ভাবি নি । আমার মনের ছেশয়াও 
কি মিতালী পায়? পাঁয় কোনোদিন ? 

নেশীর ঘোরে দিন কেটে যাচ্ছিল । ঘ1 পড়ল শেষ পর্যস্ত। 

সিনেমা দেখে বেরিয়েছি। তরুণকুমারের কোলে মিতাঁলীর 
সৃতাদৃশ্য তখনো চোখে নয়--ব্‌কের মধো বিধে আছে । আমার 
দু'কাঁন ভরে তখনো বাজছে তরুণকুমারের কানা এসো রমা” 
ভুমি ফিরে এসো-- 

আকাশ-ভাঙ? বৃষ্টি পড়ছে তখন । হল থেকেও বেরিয়েছি আর সেই 
সময় কোথা! থেকে বাবাও ছুটতে ছুটতে এসে আশ্রয় নিলেন লবীতে 1 

লুকোবার কোনে! জায়গা নেই-__মিথ্যে বলবার মতো ফীক 
নেই এতটুকুও। বিস্ময় আর বেদনার বোবা দৃষ্টিতে বাবা কেবল 
একবার আমার দিকে তাকালেন । একটা কথাও বললেন না। 
বাইরের বৃষ্টির দিকে চোখ মেলে পাথর হয়ে ধাড়িয়ে রইলেন । 
সমস্ত অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে গিয়ে আমিও ধড়িয়ে রইলুম সেইভাবেই । 
ধমুদা! এর মধ্যে কোন্‌ দিকে যে ছিটকে পড়েছিল সে আমি জানি না। 


১৬ 


বৃষ্টি থামলে বাবা আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, টুন, 
বাবে ভূমি আমায় সঙ্গে ? 

বললুম, চলো । 

বাড়ির পথে আমাকে একট। কথাও বললেন না। কৈফিয়ত 
চাইলেন না, ধিক্কার দিলেন না, গালমন্দও করলেন না। সংসারে 
এমন বিশ্বাসঘাতকতা ও আছে-_যার জন্তে ক্ষোভ করবার, নালিশ 
করবার শক্তিও মানুষ হারিয়ে ফেলে। শুধু নিঃশব্দে প্রায় কুঁজো 
হয়ে বাবা পথ চলতে লাগলেন । 

পথে কিছু বলেন নি, বাড়িতেও না। কোনো কথা জানতে 
দিলেন না মাকেও। কেবল পরদিন খেতে বসে বললেন, আজ 
অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হবে। একবার কালীঘাটে যাব। 
রাধিকা চাটুষ্যের বড় ছেলে এবার এম-এ পাশ করে ভালো 
চাকরি পেয়েছে । ভাবছি টুন্ুর সঙ্গে ভার বিয়ের কথা পাড়ব। 

আমি দরজার পাশে বসে বাবার জন্যে সুপুরি কুচোচ্ছিলুম । 
একটুর জন্যে আমার আঙুলে জাতির চাঁপ পড়ল না। 

মা আশ্চর্য হয়ে বললেন, সেকি কথা! তুমি যে বলেছিলে, 
কাঁব্য-ব্যাকরণ পাশ না করিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবে না ? 

বাবা বললেন, ত৷ বলেছিলুম বটে। কিন্তু সুপাত্র পেলে আর 
দেরি করে লাভ কী! তা ছাড়! টুন্বর যে বিয়ের বয়েস হয় নি তা-ও 
তো নয়। আমাদের পরিবারে ন' বছরে গৌরীদান হত বরাবর । 
ভূমিও তে বারে বছরে এ-সংসারে এসেছিলে, মনে আছে সে কথা? 

শাড়ির জীচল দ্রাতে চেপে, মা! কী বলেন তাই শোনবার জন্তে 
আমি অপেক্ষা করতে লাগলুম । 

মা কিন্তু অতি সহজেই মেনে নিলেন বাবার কথা। একটা 
গ্রুতিবাদ পর্যস্ত করলেন ন1। 

বেশ তো, ভালো ছেলে যদি হয়, দেখো না কথাবার্তা 
কয়ে । আর মেয়ে তো আমাদের লক্ষ্মীর প্রতিমা । স্বভাবচরিত্রে, 
রূপেগুণে এমন মেয়ে কলকাতায় আর-একটিও নেই। 

এ 


বাব! সংক্ষেপে বললেন, ভু" !--ওই ছোট্র শকটুকুর ভেতরে 
'যে কতখানি বেদনা, ঘ্বপা' আর ব্যঙ্গ মিশে আছে, সেট! অনুভব 
করে আমার ঘরের মেঝেয় একেবারে মিশে যেতে ইচ্ছে হল। 

কিন্ত আর আমি কী করতে পারি? ধরা যখন পড়েছি-_তখন 
আর ফেব্রবার পথ নেই। যা করবার আজই করতে হবে এক্ষুনি । - 

বাবা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনুদাকে আমি চিঠি 
লিখলুম। তার পরে মা যখন তেতলায় পুজোর ঘরে গেছেন, আর 
খুকু সান করতে গেছে কলে, তখন টুপ্‌ করে রাস্তায় বেরিয়ে 
মোড়ের লেটার বাক্সে চিঠিট। ছেড়ে দিলুম | 

বাব! মন্দাকে বড় বেশি বিশ্বাস করতেন। অত বিশ্বাস করে 
ভালে। করেন নি। 

'*"কিন্ত এসব তো ভূমিকা। এ আর বাড়িয়ে লাভ কী। 
বাইরে কোথায় যেন ঘড়ির শব্দ হচ্ছে--রাত বারোটা । বেশি সময় 
আমি আর দিতে পারব না। যা বলবার এখুনি বলে নিতে হবে ।--. 

অফিস থেকে ফিরে বাবা টিউশন করতে গেছেন। দোতলায় 
পুজোর ঘরে মা সন্ধ্যের শখ বাজাচ্ছেন। সেই সময় আমি ঘর 
ছাড়লুম। 

সমস্ত রাত কেঁদেছি। নিজের কাছে. নিজে প্রার্থনা করেছি-_ 
মুক্তি দাও, এই সর্ধনাশের নেশ! থেকে আমায় মুক্তি দাও। পরের 
দিনটা! জবর হয়েছে বলে বিছানায় পড়ে থেকেছি, কিছু খাই নি। তবু 
পারলুম না। আমার এতদিনের সব শিক্ষা-_-সব সংস্কার কোথায় 
ভেসে চলে গেল। 

মহামহোপাধ্যায় বংশের মেয়ে আমি। কত সতীর কত পবিত্র 
রক্ত বইছে আমার শরীরে । তবুও আমার ঘর ছাড়তে হল। 

মনুদা পাকা লোক । ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিল । আর সেই ট্যাক্সিতে 
ছিল আর-একজন অচেন! মান্ুষ। কোটপ্যাণ্ট-পরা॥ চোখে নীল চশমা । 

মমুদা আমার কানে কানে বললে, ভয় নেই। উনি আমাদের 
নিয়ে যাবেন। লাইনেরই লোৌক। 


৯৮ 


ট্যাক্সি চলল! পেছনে পড়ে রইল সেই বাভা--যে রাস্তা দিয়ে 
প্রত্যেক দিন আমি গঞঙাক্সান করে ফিরে আসতুম। পড়ে রইল 
সেই বাড়ি--যে বাড়িতে মা! এখনও সন্ধ্যার শশাখ বাজাচ্ছেন। 

ট্যাক্সি এসে থামল বালীগঞ্জের এক প্রকাণ্ড বাড়ির সামনে। 
উঠলুম তারই তেতলার এক ফ্ল্যাটে । 

ফিল্ম ডিরেক্টার দত্ত একটা ছোট টেবিলের সামনে নীল আলো 
জ্বেলে কী যেন লিখছিলেন। আমাদের দিকে ভালে! করে না 
তাকিয়েই বললেন, বনুন। 

আমরা বসলুম। একটা সোফার নরম গদির মধ্যে নিজেকে 
এলিয়ে দিয়ে এতক্ষণ পরে আমার মাথা ঘুরতে লাগল । মনে হল 
আমি তলিয়ে যাচ্ছি । আমার শরীরের নিচে সোফার গদি নেই, 
মেজে নেই, কিছুই নেই ; আমাকে যেন কেউ একরাশ পেঁজ1 তুলোর 
মধ্যে বসিয়ে দিয়েছে, আর আমি আস্তে আস্তে তার ভেতর দিয়ে 
অতলাস্ত শুহ্যতায় নেমে চলেছি । ঘরের ভেতর কোথায় যেন ফুল 
আছে--কোথাও ধুপের কাঠি জলছে--গন্ধ পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি 
না। ওই গন্ধের সঙ্গে আমাদের পুজোর ঘরের গন্ধ এক হয়ে গিয়ে 
আমার সমস্ত চেতনাকে অবশ করে আনল । 

হঠাৎ কোথা থেকে একরাশ তীব্র আলো এসে আমায় জাগিয়ে 
দিলে । লেখ! শেষ করে দত্ত উঠেছেন, জোরালো আলোটা জ্বেলে 
দিয়েছেন । আমি নড়েচড়ে সন্ত্রস্ত হয়ে বসলুম । 

দত্ত ছু'পা এগিয়ে এলেন । মিনিটখানেক অপলক চোখে চেয়ে 
রইলেন আমার দিকে । তার পর বিন্ময় আর হতাশ! মেশানে? গলায় 
বললেন, একি কাণ্ড করেছ অনিল ! 

সেই নীল চশমা-পরা৷ ভদ্রলোক, অনিলবাবু বললেন, কেন স্যার 
- আমার তে। ভালোই মনে হল । 

ভালে 1-ডিরেক্টার বললেন, একে দিয়ে কী হবে? এযে 
মিতালীর নকল। একে কে চান্স দেবে? আসল থাকতে নকলকে 
নেবে কে? 


৯৯ 


একক মুহুর্তে আমান সারা শরীর হিম হয়ে গেল। যে-কখাটা 
আমার অনেক আগে বোঝা উচিত ছিল দে-কথা বুঝতে পেরেছি 
অনেক দেরিতে । কিন্তু এখন আমি কোথায় দাড়াব ? যে-বাঁড়ি থেকে 
বেরিয়ে এসেছি সেখানে তো আর আমার ফিরে যাওয়ার পথ নেই। 

আমার পনেরো! বছয়ের চোখের সামনে সারা পৃথিবীর আলো 
নিভে গেল। আমি প্রথম আত্মহত্যার কথা ভাবলুম । 

ডিরেক্টার জ্রানলায় পিঠ দিয়ে আবার আমার দিকে তাকালেন । 
বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনার নিজের যদি কোনো 
চেহারা থাকত, আমি আপনাকে সুযোগ দিতৃম। কিস্তু ভগবান 


আপনার সে-পথ বন্ধ করে রেখেছেন । ফিল্ম লাইন আপনার নয়--- 
আপনি ফিরে যান। 


আর্তনশদ করে উঠল মন্দ]! । 

ফিরে যাবে কী করে? বাড়ি থেকে যে পালিয়ে এসেছে । 

বাড়ি থেকে পালিয়ে 1__ডিরেক্টার চমকে উঠলেন £ ছিঃ 
ছিঃ--এ কী করেছেন !_ সমস্ত মুখে তার বিব্রত বিরক্তি ফুটে 
বেরুল : কিন্তু আমি কী করি বলুন তো? খামকা আমাকে 
এমন বিশ্রী ফ্যাসাদের মধ্যে ফেললেন কেন ? 

আমি উঠে ফ্লীড়াতে যাচ্ছিলুম । না কাউকেই আমি ফ্যাসাদে 
ফেলতে চাই না। আমার পথ খোলাই আছে। গঙ্গার কালো 
জল জীবনের সব কালোকে মুছে দিতে পারে । আমি ঠিক 
খুঁজে নিতে পারব গঙ্গা কোন্‌ দিকে। 

ঠিক তক্ষুনি কে যেন বললে, আসতে পারি মিস্টার দত্ত ? 

গলার স্বর নয়--সেতারের তারে যেন ঝঙ্কার উঠল । বিছ্যুৎ 
ছুটে গেল আমার মাথার ভেতরে । ও গলা আমি চিনছি। 
শোনবাঁর সঙ্গে সঙ্গেই চিনেছি । 

দরজার পর্ণ সরিয়ে মিতালী ঢুকল । 

দত্ত হেসে উঠলেন £ আরে কী কোয়েন্সিডেন্স! এসো মিতালী 
--এসো। একটা মজার জিনিস দেখাচ্ছি তোমাকে। 


০ 


ইচ্ছে করছিল, এই ঘয় থেকে পাগলের মতে! এই মুহূর্তে 
আমি ছুটে পালিয়ে যাই। চিড়িয়াখানার জীবের মতে। সকলের 
কৌতুক আর কৌতুহল-ভর! দৃষ্টির আমি শিকার হতে চাই না। 
আমিও মহামহোপাধ্যাক্স বংশের মেয়ে, আনগারও নিজের একটা 
মহিমা আছে- আমারও একট মর্যাদা আছে। কিন্তু তবুও আমি 
যেতে পারলুম না। এতদিন যাকে আমার একাত্ম। বলে জেনেছি, 
স্বপ্নে কল্পনায় যার সঙ্গে নিজের মিল খু'জেছি, আজ প্রতিদ্বন্থীর 
অলস্ত চোখ মেলে তাকে আমি দেখতে লাগলুম। আজি মনে 
হল, মিতালী যদি পৃথিবীতে না থাকত, তা হলে ওর সব সম্মান 
_-সব সৌভাগ্য আমিই পেতুম। আগে থেকে ডাকাতের মতো 
এসে মিতালী আমার সব অধিকার কেড়ে নিয়েছে। 

আমি মিতালীকে দেখছিলুম । 

ঝলমলে শাড়ি, ঝকৃঝকে গয়না__মুখের ওপরে রঙের পুরু 
প্রলেপ। ওর সঙ্গে আমার মিল কোথায়? 

চমক ভাঙল দত্তের গলার স্বরে । 

একে দেখছ তো৷ মিতালী? অবিকল তোমার চেহারা ? 

তাই নাকি ?£_তুলি দিয়ে আকা ভ্র কপালে মিতালী আমার 
দিকে তাকালো । আমি সইতে পারলুম না_মাথ। নামিয়ে নিলুম। 
মিতালী বললে, ওমা-_-কী হবে! 

দত্ত হেসে উঠলেন। বললেন বেশ হয়েছে। তুমি বদি 
মিথ্যে নিজের দর বাড়াতে চাও-_কন্ট্রান্টে গোলমাল করো, 
তা হলে এঁকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। লোকে টেরও 
পাবে না। 

বেশ তো, তাই করবেন।-_-বলে হেসে উঠেই একটা অদ্ভুত 
কাণ্ড করে বসল মিতালী । আমার পাশে এসে বসে ছু'হাতে 
আমার গল! জড়িয়ে ধরে বললে, তোমার নাম কী ভাই? 

আমি কথ! বলতে পারলুম না। আমার চেতন! যেন আবার 
আচ্ছন্ন হয়ে আমছিল। মিতালীর গায়ের একরাশ তীব্র সুগন্ধির 


২৯ 


দুণির মধ্যে আমি হারিয়ে গেলুম। অস্পষ্ট গলায় নিজের লামটা 
বলেছিলুম কিন! আমার তাও আজ আর মনে নেই। 

অনেক দূর থেকে বাশীর মতো। মিতালীর গলা শুনতে পেলুম ঃ 
একটা কাজ করুন না মিস্টার দত্ত। পরণ্ড আউটডোরে যাচ্ছেন 
তো? সবই তে! লংশটে নিচ্ছেন আমার বদলে একে নিয়ে 
যান না। আমি দিনকয়েক রেস্ট নিই। 

দত্ত যেন চমকে উঠলেন । 

তোমার লংশটগুলো ? 

মিতালী বললে, ক্ষতি কী! ক্লোজ-মিড সব তো! ফ্লোরেই 
নেবেন। লংশটগুলে। ওঁকে দিয়েই চালিয়ে দিন না? 

আর ভয়েস ? 

ডাবিং করবেন । 

কতগুলে। ছবোধ্য শব্ধ স্বপ্রের ঘোরে আমার কানে আসতে 
লাগল। তারই মধ্যে দেখলুম, দত্ত উঠে দ্ীড়িয়ে ঘরময় পায়চারি 
করলেন বারকয়েক। যেন নিজের সঙ্গেই কথা কইলেন £ ডুপ্লিকেট ? 
তা আইডিয়াটা নেহাত মন্দ নয়। হলিউডেও আছে। 

ডুপ্লিকেট ! শব্দটা পরিষ্ষীর কানে এল। জানতুম না_-ওই 
শব্দটাই আমার ভবিষ্যৎ । আমার পরিণাম । 

আর সেইদিন থেকেই আমি মুছে গেলুম। মুছে গেলুম পৃথিৰী 
থেকে। 

আমি ফিলো নামলুম। 

আমি? না_-আমি নই। রুপো রঙের পর্দায় কতবার কত- 
ভাবে আমি ঝলমল করে উঠেছি। অথচ কোথাও আমি ছিলুম 
না। কত রূপে কতবার আমি দেখা দিয়েছি, অথচ কেউ আমাকে 
দেখতে পায় নি। অস্তিত্বহান অস্তিত্ব নিয়ে আমার নতুন পথের 
যাত্রা। শুরু হল। 

সেই প্রথমবারের কথা মনে পড়ছে। 

সাঁওতাল পরগণার এক পাহাড়ী নদী থেকে স্নান করে উঠছি। 


৬ 


কন্কনে ঠাণ্ডা! জল--গায়ের রক্ত জমে যেতে: চার়।. অথচ, 
কিছুতেই নিস্তার নেই। প্রায় ছ'্ঘন্টা ধরে আমাকে ভিজে গায়ে, 
থাকতে হল, তিন-চারবার নানাভাবে উঠে আসতে হল জল থেকে । 

শীতে কষ্ট পাচ্ছিলুম- কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। তার চাইতেও 
অনেক বেশি লজ্জা, অনেক বড় অপমান আমাকে ধ্লাত চেপে 
সইতে হল সেদ্রিন। সেই জানের দৃষ্টটাকে অত করে ফিল্মে 
তোলবার একটিমাত্র উদ্দেশ্তাই ছিল। ছবির গল্পে দরকার থাক 
আর নাই থাক, আমার শরীরকে ভাঙিয়ে একদল দর্শকের রুচিকে 
খুশি করাই ছিল দৃশ্যটির লক্ষ্য ৷ 

সে অপমানও সহা করেছিলুম। সন্ধ্যার শঙ্খ শুনতে শুনতে 
যেদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলুম-_-সেদিন থেকেই জানতুম 
পিছল পথে পা দিয়েছি। কিন্তু এ জ্বালার সঙ্গে আরও বড় 
জ্বালা ছিল। আমার দেহের মোহে তন্দ্রাজড়ানো চোখে ওরা 
মিতালীকেই স্বপ্প দেখবে- আমাকে নয়! ওদের প্রীতিতে ওদের 
শ্রদ্ধায় আমার ঠাই নেই-_-ওদের বাসনা-সঙ্গিনীও আমি হতে 
পারব না। 

সেই শুরু । 

জঙ্গলের পথ দিয়ে, কাঁটাবনের মধ্য দিয়ে আমাকেই ছুটতে 
হয়েছে__মিতালী রাজি হয়নি। কাটায় হাত-পা ছড়ে গেছে, 
রক্ত ঝরেছে দরদরিয়ে। আর সেই সময় গাছের ছায়ায় বসে 
জাপানী পাখা দিয়ে হাওয়া খেয়েছে মিতালী । তার পর পরী 
সেই ছবি যখন ফুটে উঠেছে-_তখন দর্শকেরা মিতালীর জন্তেই 
চোখের জল ফেলেছে-_আমার জন্তে নয়। 

ক্রমে ফিল্ম লাইনের অন্তরঙ্গ মহলে আমার নাম ছড়িয়ে 
পড়ল। না_আমার নয়। মিতালীর ডুপ্লিকেটের নাম। আমি 
ছায়ার মতো সব ছবিতে ওকে অনুসরণ করতে লাগলুম। ও 
দশ হাজার পনেরো হাজারে কণ্ট'স্ী সই করত-_-আমি পেতুম-- 
কখনে! তিন শো, কখনো পাঁচ শো। 


১৬৪ 


অভ্যন্ত হয়ে এলুম। অস্তিত্বহীন এই অভ্িন্বের বেদনাও শষ 
সময় থাকে না। কেবল মধ্যে মধ্যে এক-একটা আকন্মিক আঘাতে 
যন্ত্রণা টন্টনিয়ে উঠত। 

সহান্ুভূতিভরে মিতালী বলত £ বেচারীকে সার! জীবন ডুপ্লিকেট 
করেই রাখবেন নাকি? একটা চান্স দিন না এবার । 

লীলাভরে হেসে ডিরেক্টার কিংব! প্রোডিউসার বলতেন, ত। হলে 
তোমার গতি হবে কী? তুমি তো একেবারে বেকার হয়ে ধাবে। 

হাই ভুলে মিতালী বলত ঃ না হয় হলুমই বেকার। বিস্তর 
ছবিতে কাজ করেছি--অনেক তো! হল। এবার আপনারা ছুটি 
দিন আমায়। 

তা হলে তোমার নামের কপিরাইটটাও ছেড়ে দেবে তে ? 

বেশ তাও দেব।--বলেই ফস্‌ করে আমার গল জড়িয়ে ধরত 
মিতালী £ টুন আমার সই। ওর জন্তে সব আমি স্যাক্রিফাইস্‌ 
করতে পারি । 

কথায় কথায় গল। জড়িয়ে ধরা মিতালীর ন্বভাব। প্রথম 
প্রথম রোমাঞ্চ হত--কিস্ত গা ঘিনঘিন করত তারপর থেকে। 
মনে হত একট। সাপ গলায় পাক দিচ্ছে-তার সবনাশ! ফাস 
থেকে নিজেকে কিছুতেই আমি ছাড়াতে পারছি না--আমার 
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে। 

মিতালী আমার জন্যে নিজেকে স্তাক্রিফাইস্‌ করবে! আমি 
জানি, মিতালী জানে, সবাই জানে । রসিকতা । অথচ কী নিষ্ঠুর 
_-কী যে হৃদয়হীন! যেদিন মিতালী থাকবে না-_-সেদিন আমিও 
একটা সাগরের বুদ্ধদের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে মিলিম্ে যাব। যদি 
আজ মিতালীর মৃত্যু ঘটে, তা। হলে ওর সঙ্গে আমাকেও যেতে 
হবে সহমরণে। 

আর তখনই বুকের ভেতরটা জ্বাল করত। বিষক্রিয়! ,শুরচ 
হত ব্ক্তে। মিতালীর ওপরে একটা অসম ঘৃণায় আমি যেন 
হিংস্র হয়ে উঠতুম। 


১৩, 


আরও ছিল। ভরুণকুমারের সঙ্গে যখন শুটিং করতে হত-- 
গখখন। 

লংশটে তার হাত ধরে এগিয়ে এসেছি কতদিন। কিন্তু ষে. 
যুহুর্তে ক্যামেরা মুখোমুখি হয়েছে, তখন তরুণকুমার প্রেমের কথ! 
বলেছে মিতালীকেই। কাটায়-ভরা বনের পথ দিয়ে রক্ত-ঝারা 
পায়ে ছুটতে ছুটতে পাথরের ওপর আমি আছড়ে পড়েছি-__কিন্ত 
তরুণকুমার যার মাথ। কোলে তুলে নিয়ে ভালোবাসার সব কথ! 
উজাড় করে দিয়েছে-_সে আমি নই। 

বাসর সাজাতে হয়েছে আমাকে--আর সেই বাসরের রাণী 
হয়েছে মিতালী । 

কতদিন আউটডোর শুটিডে গিয়ে আমি আর মিতালী রাত 
কাটিয়েছি এক ঘরে । হয়তো জানাল! দিয়ে দেখা দিয়েছে সেই 
পুরোনো সপ্তধি_হয়তো বশিষ্ঠের পাশে জ্বলেছে অরুহ্ধতীর সতী- 
প্রদীপ, হয়তো ঞ্ুবনক্ষত্রের কিরণকণা পুরোনো দিনের মতোই 
আমার মুখের ওপরে আশীর্বাদের মতো ঝরে পড়তে চেয়েছে। 
আমি সহা করতে পারি নি। জানল বন্ধ করে দিয়েছি। 

আর ঘুমন্ত মিতালীর দিকে ক্ষুব্ধ বাঘিনীর মতে জ্বলস্ত চোখ 
মেলে রেখে ভেবেছি, এই রাতে আমি ওকে ইচ্ছে করলেই খুন করতে 
পারি--সরিয়ে দিতে পারি আমার এই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর প্রতিদ্বন্বীকে। 
এরই জন্যে পৃথিবীতে আমি থেকেও নেই। আমার শারীরিক 
সত্তার মতো! মনটাও এরই জন্যে শূন্য আর নিরর্৫থক হয়ে গেছে। 
এই মিতালীই আমার কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। যে 
সম্মান, যে অর্থ, জীবনের সবচেয়ে বড় যে সার্থকতা-_সব কিছু 
থেকে এই তো বঞ্চিত করেছে আমাকে । 

আমি আমার পথের কাটা এখুনি সরিয়ে দিতে পারি। এই 
মুহূর্তেই পারি । না__তবুও আমি পারি না। আমি জানি, মিতালীন়্ 
সৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও যেতে হবে সহমরণে । 

,-"ছুটো বাজল। বাইরে সেই ঘড়িটা আমার সঙ্গে রাত 


২ ৫ 


জাগছে। দিনের আলে! ফুটলে আমি আর জেগে থাকব না। ও জেগে 
থাকুক। ওর চোখে কখন শেব ঘুম আসবে, সে-খবর শুধু ওই জানে। 

স্টডিওতে শুটিং চলছিল। আমার কোনো কাজ ছিল নাঁ_ 
টাকার জন্তে এসেছিলুম। মিতালীর মতে! আমি ভাগ্যবতী নই। 
আমার বাড়িতে কেউ চেক পৌঁছে দেয় না সেজন্যে আমাকেই 
ঘোরাঘুরি করতে হয়। 

ফ্লোরে মিতালীর কাজ হচ্ছিল। সেখানে দাড়াতে আমার ভালো 
লাগল না। টাকাটাও পেতে একটু দেরি হবে। আমি আস্তে 
আস্তে বেরিয়ে এলুম। স্ট,ডিয়োর বাগানের নিরিবিলি এক কোণায় 
যেখানে কতগুলো আইভি একটা বসবার জায়গাকে ঢেকে রেখেছে, 
আমি সেখানে এসে বসলুম। দেখতে লাগলুম, সামনের একটা 
শিউলী গাছে একজোড়া বুল্বুলি তাঁদের বাঁস! বাঁধছে। 

দেখছিলুম আর বুকের ভেতরট1 কি রকম লাগছিল। কোনে! 
কারণ ছিল না-_-তবু কখন আমার চোখে জল এল। 

একি-টুন্ধ ? চুপচাপ বসে বসে কাদছ এখানে ? 

আমি চমকে উঠলুম। তরুণকুমার। চোখের জল মুছে 
ফেললুম ততক্ষণাৎ। 

আপনি এদিকে ! 

ফ্লোরের গরমে মাথা ধরে গিয়েছিল। একটু হাওয়া খেতে 
বাগানে বেরিয়েছিলুম। দূর থেকে আবছাভাবে ঝোপের আড়ালে 
তোমাকে দেখে এগিয়ে এলুম | 

আমি ঠাট্টা করে বললুম, ভারী নিরাশ হলেন তরুণদা। এসে 
দেখলেন আমি মিতালী নই। 

তরুণকুমার আমার পাশে বসে পড়ল। সিগারেট ধরিয়ে 
বললে, না_সে ভূল আমি করি নি। বাগানের ভেতরে এসে একা 
কী করে বসে থাকতে হয়-মিতালী তা জানে না। ও হলে 
আরও সাত-আটজনকে জমিয়ে এনে এখানে হাসি-গল্পের আসর 
বসিয়ে দিত। তোমার মতে চোখের জল ফেলত না। 


হ্ঙ 


এ-সব কেন বলছে তরুপকুমার 1? এ তুলনা কেন? আমি 
ওর মুখের দিকে তাকালুম। 

আর তরুণকুমারও আমার দিকে তাকিয়ে রইল । যেন হটে 
কালে রঙের তারা ফুটে রইল আমার চোখের সামনে । তার পর 
বললে, মিতালী ছবিতে খুব কাদতে পারে । কিন্তু জীবনে কোথাও 
ওর কান্না নেই। আর তোমাকে দেখলে কী মনে হয় জানো? 
তোমার চোখছুটো এগ তরল ষে, হঠাৎ একদিন ফৌোটাকয়েক 
শিশিরের মতো! টপ টপ করে ওর। ঝরে পড়তে পারে । 

সাজিয়ে সাজিয়ে ও-সব ছবির ভায়ালগের মতো কথা! আমাকে 
কেন শোনাচ্ছে? আমি কি খুশি হব? কিন্ত বেশ বুঝতে 
পারছিলুম, আমার চোখ আবার জলে ভরে আসছে। বলা যায় 
না_কিছুই বলা যায় না। হয়তো এখুনি সত্যি সতাই ওরা 
তরুণকুমারের পায়ের ওপর টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে যাবে। 

ছু'আডুলে অন্তমনক্কভাবে সিগারেটটা ধরে রেখে তরুণকুমার 
আবার বললে, আমি ভাবি টুন্থ, মিতালীর তো আর সবই 
আছে। শুধু এই রকম চোখ যদি থাকত! যদি তোমার চোখ 
ছুটো ওকে তুমি দিতে পারতে ! 

আমার চোখের জল সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে এল। তরল হয়ে 
যারা গড়িয়ে আসছিল, হীরের মতো। কঠিন হয়ে গেল তারা । 
আমাকে দিতে আসে নি তরুণকুমার- কিছুই দিতে আসে নি 
মিতালীর পাওনা থেকে একটি কণাও মে আমাকে দেবে না। 
তার বদলে আমার চোখ ছটোকে সে কেড়ে নিতে এসেছে। 
শিশুকে গলা টিপে হত্যা করে ডাকাত যেমন তার সোনার 
হারছড়া নিয়ে গিয়ে নিজের রাত্রির সঙ্গিনীকে উপহার দেয় ! 

আমি তক্ষুনি উঠে দীড়ালুম। তিক্ত স্বরে বললুম, বেশ তাই 
হবে। মরবার সময় উইল করে যাব, আমার চোখ ছুটে যেন 
মিতালীকে উপহার দেওয়া হয়। 

রাগ করলে নাকি? বোসো টু, বোসো-_ 


খন 


কিন্ত আমি বসতে পারলুম না। বাগান থেকে সোজ। 
বেরিয়ে এসে, স্টুডিয়োর গেট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে 
এলুম। টাকাটার জন্মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলুম না। 

ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমি বিছানার ওপর লুটিয়ে 
পড়লুম। কত দেব আমি-কভ আর মিতালী কেড়ে নেবে 
আমার কাছ থেকে? আমার পরিচয়, আমার অস্তিত্যথ আমার 
স্বপ্ন, আমার বাসন।--সবই তে! সে নিঃশেষে লুট করে নিয়েছে। 
বাকী আছে আমার কান্না-_-আমার চোখ । তাও নেবে? তার পর? 
তার পর আমার কীহবে? এই অস্তিত্বহীন অস্তিত্কে আমি 
বইব কী করে? 

অথচ তখনও মিতালী এক গাল হেসে ঝুপ করে আমার 
পাশে বসে পড়বে । সাপের মতে। ছটে। হাত দিয়ে হঠাৎ আমার 
গলা জড়িয়ে ধরবে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে, আর আধো 
আধেো। আছরে গলায় বলতে থাকবে £ টুক্ম আমার সই। ওর 
জন্তযে আমি সব করতে পারি। 

পৃথিবীতে এমন কুৎসিত অপমান এর আগে বুঝি কেউ 
কাউকে করে নি। 

আমি হিংত্রভাবে বালিশের ওপর নখ বসিয়ে দিলুম। মনে 
হতে লাগল একটা বুনে৷ জন্তুর মতো! ধারালে। নখের আচড়ে 
আমি যেন কার গলা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি ! 

কিন্ত এ তো একদিনের কথা নয়। এই যন্ত্রণা--এই জ্বাল! 
-এ যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। আবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে 
আমি পহজ হয়ে উঠলুম। তাকিয়ে দেখলুম, টেবিলের ওপর 
কল-কাঙ্ পড়ে আছে। চারদিন পরে কাশী যাওয়ার প্রোগ্রাম 
কয়েকটা আউটডোরে মিতালীর ডুপ্লিকেটের কাজ করতে হবে । 

সে পরশুর কথা। কিন্ত আজ আমি ঠিক করে ফেলেছি। 
কাশী আর আমি যাব না। ডুপ্লিকেটের ভূমিকার অভিনয় আমার 
শেষ হয়ে গেছে। 


ক 


বিকেলে তরুণকুমার এসেছিল । 

শোনো, সুখবর আছে। এই পাঁচ বছর পরে শেষে রাজী. 
হয়েছে মিতালী । | 

কিসে রাজী হয়েছে ?_-আমার হাংপিগড চমকে উঠল। 

আমাকে বিয়ে করতে । আসছে মাসের সাতুই। রেজেক্ি 
হবে ওই দ্িন। রাত্রে গ্রীতিভোজ ।-_হলদে রঙের একট চিঠি 
আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে, যেয়ো কিন্তু । 

আশ্চর্য হলুম ? ন1। খুববেশি আঘাত পেলুম ? তাও না। 
আজ তিন বছর ধরে মনে মনে আমিও এই দিনের জন্তেই তো! 
প্রতীক্ষা করছিলুম। হয়তো আধো ঘুমে ব্বপ্পের মতো৷ এ-কথাও 
ভেবেছি, মিতালীর ভেতর দিয়ে তরুণকুমারকে আমিও পাব--হয়তে। 
মিতালীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কথাও ওর মনে পড়বে। 

হাসবার চেষ্টা করে আমি বললুম, নিশ্চয় যাঁব। 

তরুণকুমার বেরিয়ে যাচ্ছিল। দরজার গোড়ায় গিয়ে ফিরে 
দাড়ালো । কী ভেবে, সেদিনকার মতো আমার দিকে কিছুক্ষণ 
তাকিয়ে থেকে বললে তোমাদের ছ'জনকেই একসঙ্গে বিয়ে করতে 
পারলে মন্দ হত না।--তার পর খানিকটা ছুর্বোধ্য হাসি হেসে 
বললে, সে উপায় যখন নেই--তখন মাঝে মাঝে আসতে হবে 
তোমার কাছে। মিতালীর বুকে কান্না নেই--সে চোখের জল 
ফেলতে জানে না। যখন চোখের জলের জন্যে প্রাণ ছটফট 
করে উঠবে, তখন তোমার কাছেই আমাকে আসতে হবে টুহু। 

তরুণকুমার চলে গেল। বাইরে মোটরের শব্দ শুনতে পেলুম। 

ব্যাস্‌__এই পর্যস্তই । আর নয়। আর আমি সইতে পারৰ 
না। ছুঃখ দেবে একজন আর কান্না দেব আমি ? পর্দার অভিনয়ে 
মুক্তি নেই-__-জীবন ভরে এমনিভাবে আমাকে ভূপগ্লিকেটের কাজ 
করে যেতে হবে? আমার বুক-ফাটা চোখের জলে নিজ্ষের জালা 
জুড়িয়ে আর-একজনকে সাস্বন। দেবে তরুণকুমার ? 

আমি পারব না। এতদিন পরে বুঝেছি এইবারে সব শেষ করে 


২৯ 


দেওয়ার ময় এসেছে । নিজের অস্তিত্বহীন অস্তিত্বকে এইবারে 
সপূর্ণ মুছে দিতে হবে । 

উত্তরের জানল! খোলা । আজ দেখতে পাচ্ছি সপ্তবিকে-_ 
দেখছি বশিষ্ঠের পাশে ধ্যানমগ্রা অরুদ্ধতীকে । মনে পড়ছে, আমি 
মহামহোপাধ্যায় বংশের মেয়ে । আমাকে সংস্কৃত পড়াতে পড়াতে 
বাবা! বলছেন, আমার মেয়েকে আমি এ-যুগের মৈত্রেয়ী করে তুলব 
ব্রহ্মবাদিনী । যেনাহং নামৃতাস্যাম__ 

রাত শেষ হয়ে আসছে। সেই ঘড়িটায় চারটে বাজল। একটু 
পরেই যাব গঙ্গানান করতে । আকাশে লাল হয়ে হূর্য উঠবে-- 
আমার কপালে ছড়িয়ে পড়বে সতীসি'ছির । আমার আর সময় নেই । 


সায়নাইড খেয়ে শেষ রাত্রে আত্মহত্যা করেছিল মেয়েটি । এই 
চিঠিট। চাপা দেওয়া ছিল্প নীলরঙের ছোট শিশিটার তলায়। 


নীলকণ্ঠ 


অফিস থেকে অত্যস্ত বিশ্রী মেজাজ নিয়ে ফিরেছে সুকুমার । 
প্রথম ব্যাপার হল, এবার পুজোয় খুব সম্ভব 'বোনাস্‌ পাঁওয়! 
যাবে না এবং তাদের ইউনিয়নের এমন জোর নেই যে, তা নিয়ে 
একট আন্দোলন গড়ে তোল! যায়। ছু'নম্বর, অজিত মুখোটি 
ফস্‌ করে বলে বসল £ তোমরা সব রাশিয়ার দালাল । 

তর্ক বাধলেই এমনিভাবে আক্রমণ করে লোকটা । হিটিং 
বিলো দি বেণ্ট। অফিসের দাবিদাওয়ার প্রশ্ন-তার মধ্যে 
অকারণ বাজে কথা টেনে আনা। আমাদের দৈনন্দিন অভাব- 
অভিযোগের সঙ্গে রাশিয়ার যে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই এ কথা 
কোনোমতেই বোঝানে। যাবে না অজিত মুখোটিকে । 

অগত্যা পাল্টা জবাব দিতে হয়েছে । 

আর তুমি কোথেকে টাকা পাও মুখোটি ? ফরমোসা ? 

হাতাহাতির উপক্রম হচ্ছিল, সবাই মাঝখানে পড়ে থামিয়ে 
দিলে। কিন্তু মনের সেই বিশ্রী বিরক্তিটা কিছুতেই কাটতে 
চাইছে না সকুমারের । অহেতুক বিদ্বেষ _অর্থহীন কলহ। এ যুগে 
যেন প্রত্যেকে প্রত্যেককে ঘুণা করে। মানুষে মানুষে ওই 
একটি ছাড়া আর কোনে সম্বন্ধ খু'জে পাওয়া যায় না এখন। 
ট্রামে, ট্রেনে, অফিসে, খেলার মাঠে, চায়ের দোকানে । তর্ক, 
নিন্দা, অপমান, হাতাহাতি । কেউ আর কাউকে সহা করতে 
পারে না। 

এমন কি ঘরেও নয়। সেখানেও যেন স্বামীন্দ্রীর মধ্যে বিচিত্র 
প্রাগৈতিহাসিক প্রতিদ্বন্ৰিতা। 

বাড়িতে পা দিয়েই সেটা অনুভব করল সুকুমার । গলির 
ভেতরে অন্ধকার ঘরে বিকেল সাড়ে পাচটাতেই অকাল সন্ধ্যা 


৩১ 


নেমেছে।, আর জানলার পাশে ছায়ার ভেতরে আরও একরাশ 
'ঘন ছায়! প্লচন! করে বসে আছে অনুষ্ত্রী। 

দরজার সামনে সুকুমার দাড়িয়ে পড়ল। নিজেকে যেন 
প্রস্তত করে নিলে কয়েক মুহর্তে। আজ আবার একটা কিছু 
ঘটবে । ঘণ্টাখানেক তিক্ত কলহ-_ল্সায়ুছেড়া যন্ত্রণা, আধপেটা 
খাওয়া আর বিনিদ্র রাতের প্রহরগুলিতে ঘড়ির আওয়াজ শুনতে 
শুনতে একান্ত প্রার্থনার মতো নিজের মৃত্যু কামনা করা। সুকুমার 
তৈরি হয়ে নিল। 

আলো! জ্বালাও নি যে? 

অনুপ্্রীর জবাব এল না। 

সুকুমার দীড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। জানলার পাঁশে বসে 
আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অন্ুণ্রী। সামনে তেতলা বাড়িটার 
ওপর দিয়ে আকাশ খুব বেশি দেখা যায় না। কিন্তু যেটুকু 
দেখা যায়, তার . মধ্যেই যেন অনুণ্রী নিজের মুক্তি খু'ঁজছে। 
নুকুমারের কাছ থেকে মুক্তি_-এই জীবন থেকে মুক্তি ।**" 

“*ম্ুকুমার জানে, সে অন্থুগ্রীকে সুখী করতে পারে নি। বাড়ির 
সঙ্গে সব সম্বন্ধ মুছে দিয়ে, পরিবারে ঝড় তুলে অন্ুশ্রী এসেছিল 
তার কাছে। ভেবেছিল, সুকুমার পুরুষের মতো চারদিকের 
অপমান থেকে তাকে রক্ষা করবে, তাকে মর্যাদা দেবে, পুরে। 
দাম দেবে তার ত্যাগের, তার ভালোবাসার । কিন্তু অনুশ্রী 
জানত ন! সুকুমার দেবতা নয়, তার ভুল আছে, তার ক্রটি আছে, 
তার দুর্বলতা আছে। চারদিকেই ছুর্যোগের ভেতরে সে অনুশ্রীর 
কাছেই আশ্রয় চায়, অনুণ্রীকে একান্ত করে আশ্রয় দেবার শক্তি 
নেই তার। 

শুরু হল ভূল বোঝবার পালা । বিষ জমতে লাগল দিনের 
পর দিন। 

সুকুমার জানে আজ আট বৎসর ধরে অনুণ্রী মুক্তি চাইছে 
ভার কাছ থেকে । দেখছে, তার চোখে অভ্ভুত বন্যদৃষ্টি, তার 
৮১৭ 


সুখ যন্ত্রণায় নীল। যেন হিংশ্রতম শত্রুকে দেখছে এমনি ভঙ্গিতে 
এওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে কতদিন। সামনে থেকে 
খাবারের থাল। ছুড়ে ফেলে দেবার রা প্রেরণা অনেক কষ্টে 
সংবত করেছে সুকুমার | 

নিপ্রাহীন রাতে মাথার মধ্যে যখন লক্ষ লক্ষ যন্ত্রণার ছুণ্চ 
বিধেছে ঘড়ির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে, সে যখন নিজের মৃত্যু- 
কামন। করেছে, তখন হয়তে। চোখে পড়েছে, মেঝেতে মার বিছিয়ে 
পড়ে অনুশ্রী কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে। সহানুভূতির উচ্ছ্বাসে 
নিজের যন্ত্রণা ভূলে গেছে সুকুমার, পাশে এসে বসেছে অনুণ্রীর । 
মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার সাহস হয় নি, কেবল গভীর মমতায় 
মন্ত্রোচ্চারণের মতো নিঃশব্দে বার বার বলেছে, ছুটি দেব, এবার 
তোমায় ছুটি দেব । আর এমন করে বেঁধে রাখব না। 

ছুটি দেওয়া খুব শক্ত কাজ নয়। সিভিল ম্যারেজের বিয়ে । 
আগুন আর শালগ্রাম শিলা সাক্ষী থাকে নি, ফ্রবতারা আশীবাদ 
করে নি, হোমের ধেখয়ায় পিতৃলোকের ছায়াশরীর আবিভূত হয় নি, 
সপ্তপদীর পদসঞ্চারে জন্ম-জন্মাস্তরের বন্ধন তৈরি হয় নি, চুক্তিপত্র 
স্বাক্ষর করে দু'জনে ঘর বেঁধেছে । রেজিস্ট্রেশন ফর্ম ইহ-পরকালের 
অচ্ছেগ্য ডোর নয়--ওটাকে ছিড়ে টুকরো করতে কয়েক সেকেগ্ডের 
বেশি সময় লাগে না। 

কিন্তু! 

ওই কিন্তুটাই আশ্চর্ব। সুকুমার জানে ওই দ্বণার সঙ্গে কী 
অন্ধ ভালোবাস! পাকে পাকে বেঁধেছে অন্ুত্রীকে । সুকুমার কাছে 
থাকলে সে সহা করতে পারে না। দূরে চলে গেলে আরও 
অসহা লাগে। একদিনের জন্যে সে কলকাতার বাইরে গেলে 
অন্ুণ্রী ছটফট করে--পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে । মেয়ে 
থুকু না থাকলে হয়তো রান্নাবান্নাও সে করত না। অথচ বাড়ি 
ফেরবার সঙ্গে সঙ্গেই বিচিত্র অভ্যর্থনা । 

এত তাড়াতাড়ি এলে যে? -অন্ুশ্রীর ঠোঁটের কোণে জ্বাল। 


৩৬ 


'ভর!হাধি ঠিকরে পড়ে। বন্ধুর বাড়িতে আরও পাঁচ-সাত দিন 
কাটিয়ে এলেই পাঁরতে । শরীর-মন ছুই জুড়োত । 

স্বকুমারের ইচ্ছে হয়েছে সেই মুহুর্তেই সে আবার ফিরে 
যায় হাওড়া স্টেশনে । যে কোনে। গাড়ীতে উঠে পড়ে, চলে যায় 
যেদিকে খুশি । 

সৃকুমার জানে। মুক্তি অনুণ্ী নিতে পারে না। স্ুকুমারই 
কি দিতে পারে? অনুণ্ী চলে গেলে তার পায়ের তল। থেকে 
পুথিবী সরে যাবে । শরীর আর মনের অভ্যাস হয়ে গেছে যে, 
অনুশ্রীহীন নিজের অস্তিত্ব সে কল্পনাই করতে পারে না। 

তার বন্ধন ওই খুকু। ওই ছ'বছরের মেয়েটা] । 

মা আর বাঁবা-_-কাঁউকে ছেড়ে সে থাকতে পারে না। মা'র 
চোখে জল দেখলে সে সুছিয়ে দিতে আসে, বাবার মুখ গম্ভীর 
দেখলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ছু'হাতে। 

সব সময় সে আদর পায়, তা নয়। মা হয়তে। খামক। 
তার পিঠে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে বলে, মর্--মর তুই । তুই মরলেই 
আমি বাচি। তা! হলেই আমার ছুটি। 

খুকু আগে কাদত। এখন আর কাঁদে না। ছুটে! জলভরা 
চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার পর সুকুমারের কাছে 
এলে ডাকে ; বাবা! 

সুকুমার বলে, এখন আমায় বিরক্ত করো না খুকু । খেলা 
করে গে যাও । 

খুকু ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ছোট টিনের বাক্সট! খুলে 
তার খেলার সরঞ্জাম নিয়ে বসে। 

গোটাকয়েক ন্যাঁকড়া আর সেলুলয়েডের পুতুল, মা'র ব্লাউজ 
আর শাড়ীর কয়েকটা টুকরো, কয়েক ছড়া পু'তির মালা! আর 
একটা লাল বল সামনে ছড়িয়ে নিয়ে চুপ করেবসে থাকে। 
কী যে ভাবে সে-ই জানে। 

অন্ুত্রী হঠাৎ জবলস্ত চোখে তাকায় সুকুমারের দিকে । 


৫ 


€তোমার চালাকি আমি বুঝতে পানি না ভাবছ? 

চালাকি 1-_ সুকুমার ভূরু কৌচকায়। 

চালাকি নয়তো কী। মেয়েটাকে ছেড়ে এক পা-ও আমি 
চলে যেতে পারি না,সে তুমি জানো । তাই আমাকে যা মুখে 
আসে তাই বলো। 

অসহ্য বিরক্তির মধ্যেও হাসি পায় সুকুমারের । খুকুর জম্বেই 
কি চলে যেতে পারে ন' অনুষ্ী? শুধু খুকুর জন্কেই ? 

শীতল শ্াস্ত গলায় স্থকুমার বলে, বেশ তো, খুকুকে নিয়েই 
তূমি আলাদ! হয়ে যাও। 

যেতেই তো! চাই। কিন্তু তাতেও তুমি বাদ সেধেছে। 
কী মন্ত্রে মেয়েকে বশ করেছ সে তুমিই বলতে পারো! । তোমার 
কাছ ছাড়া করলে একট! দিনও ওকে বাঁচাতে পারবো না। তুমি 
আমাকে মারবে, মেয়েটাকেও মারবে । 

ছু'ধারী তলোয়ার । কোনোদিকেই পরিত্রাণ নেই। সুকুমার 
চুপ করে থাকে । 

সত্যি খুকুই সব চেয়ে বড় বাধা। রাত্রে ঘুমের ঘোরে 
একবার বাবাকে খোজে--একবার মা-কে । বুকের ওপর তার 
ছোট নরম হাতখানা চেপে ধরে সুকুমার ভাবে, খুকুর জন্যেই 
তাকে বাঁচতে হবে, প্রতিদিনের বিষ নীলকণ্ঠের মতো পান করেও 
বেঁচে থাকতে হবে । 

আত্মহত্যার চেষ্টা কি করে নি? সে ব্যবস্থাও হয়েছিল একদিন | 
একটা ঘুমের ওষুধ সে সংগ্রহ করেছিল, যার গোটা ছয়েক 
ট্যাবলেট একসঙ্গে খেলে ঘুম আর কোনোদিন ভাঙবে না। ছোট 
টেবিল ল্যাম্পট। জ্বেলে আনুষ্ঠানিক চিঠিট' পর্যস্ত লিখে ফেলেছিল £ 
আমার মৃত্যুর জন্তে কেহ দায়ী নয়-_ইত্যাদি। তার পর এক 
গ্লাস জল নিয়ে যখন সে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলেছিল, সেই 
সময় খুকু কেঁদে উঠল ঘুমের ঘোরে । 

বাবাঃ কোথায় যাচ্ছ? আমিও যাব। 


এমন তো! কতদিন বলেছে খুকু । সঙ্গে বেড়াতে যাবার জন্টে 
কেঁদেছে, ঘায়ন! ধরেছে। কিস্ত আজ এই কান্না সম্পূর্ণ একটা 
নতুন অর্থ নিয়ে এল সুকুমারের কাছে--যেন একটা তীর এসে 
তার বুকে বিধল। সুকুমার দেখল টেবিল ল্যাম্পের ফিকে নীল 
আলোয় খুকুর যুখ কী পাঙুর, কী করুণ হয়ে গেছে। চোখের 
কোণে চিকচিক করছে জলের রেখা । 

সুকুমার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চিঠিটা ছি'ড়ে কুচি কুচি করে 
ছড়িয়ে দিলে বাইরে। দ্বুমের ওষুধট1 লুকোল টেবিলের টানার 
ভেতরে | ক্রাস্ত হতাশায় গ্লাসের জলট! নিঃশেষ করে আলো 
নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। 

বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ছু'একজন যারা ব্যাপারটা! জানে, তারা 
উপদেশ দিতে চেষ্টা করে । 

ব্যাপারটা মিটিয়ে দাও না হে, যা হোক একটা কম্প্রোমাইজ 
করে ফেলো। এভাবে রাতদিন স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে কেউ 
বাচতে পারে নাঁকি ! 

বর্ণহীন হাসি হাসে সুকুমার । 

তাই তে। ভাবছি £ অরণ্যং তেন গস্তব্যং। এবার বানগ্রস্থই 
নেব, বাস বাধব সুন্দরবনে গিয়ে । 

তাতে সুবিধে হবে না । এটা সত্যযুগ নয়, একালে জঙ্গলের 
মালিক গভনমেন্ট। বনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্ট 
ট্রেসপাস কিংবা পোচিং-এর দায়ে থানায় চালান করে দেবে। 
ওসব মতলব ছাড়ো । একটা রফা করো স্ত্রীর সঙ্গে 

রফা? কিন্তু কোনখানে রফা করবে সুকুমার? এমন তো 
বড় কোনো ঘটন। ঘটে নি, যাঁর জন্যে স্বামী-্দ্রীর ভেতরে এই 
মনোমালিম্তের স্ষ্টি হয়েছে; এমন তো স্পষ্ট কোনে। কারণ ঘটে নি 
যে জন্ভে এ ওকে ভূল বুঝতে পারে। এই বিদ্বেষ তার অঙ্কুর 
পেয়েছে অবচেতনার কোন্‌ অন্ধকার মৃত্কক্ষ থেকে, সহস্র মূল 
কোনে জটিল গুল্পের মতো এ নিজের বিষরস আহরণ "করছে 


১১১০ 


সংসারের অগণিত তুচ্ছ বস্ত্ব থেকে। একে উৎপাটিত করবার. 
কোনো উপায় নেই, নিজেকে উপড়ে ফেলবার আগে পর্যস্ত এর 
পাঁশবন্ধন সুকুমারকে মুক্তি দেবে না। ৰ : 

দূরে চলে যাওয়ার উপায় নেই--অন্ুশ্রীর দ্বণা জর্জরিত অথচ 
অন্ধ ভালোবাস তাকে ছুনিবার টানে চক্রপাকের মধ্যে নিয়ে 
আসবে ; মরবার শক্তি নেই, খুকুর ডাক শোনা যাবে পেছন থেকে, 
'তার শীর্ণ করুণ মুখের ওপর টেবিল ল্যাম্পের নীল আলে! কী 
বিষাদের মতো জড়িয়ে ধরবে তাকে ! 

আর এইভাবেই বাঁচতে হবে সুকুমারকে । আরও পচিশ বছর, 
ত্রিশ বছর- হয়তো আরও বেশি । এবং খুব সম্ভব, সুকুমার পাগল 
হয়ে যাবে না। চাকরি করবে, বাজার করবে, সামাজিক সম্পর্ক 
রক্ষা করবে__নিজে রসিকতা করে অন্যকে হাসাবে এবং অন্যের 
রসিকতায় পাগলের মতো। হেসে উঠবে ! 

আশ্চর্য ! 

মানুষ বাচে কেন? 

এই দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর জেনেছে সুকুমার । অভিনয় করবার 
জন্যে ।."" 

দরজার গোড়ায় প্রায় দশ মিনিট নীরবে দাড়িয়ে থেকে 
সুকুমার সুইচটা টেনে দিলে। ঘরের দেওয়ালে, ছবির কাচে, 
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার আঁলোটা হঠাৎ জ্বলে উঠল খানিক 
আগুনের মতো । অনুণ্ী ফিরে চাইল একবার, তার পরেই দু'হাতে 
চোখ আড়াল করে আবার মুখ ফিরিয়ে বসল জানালার দিকে। 

জবাব পাবে না জেনেও অভ্যাস রক্ষার জন্তে সুকুমার বললে, 
শরীর ভালে। নেই? 

অনুণ্ী চোখ ঢেকে বসে আছে । আকাশটাও বোধ হয় আর 
দেখতে পাচ্ছে না এখন। একরাশ কালে মেঘ জম! হয়েছে 
সেখানে । মুক্তির নীল বিস্তার আর নেই, এখন মনের ভার বদ্র- 
'বিহ্যৎ-বর্ষণের জন্তে স্তম্ভিত হয়ে রয়েছে। 


৩৭ 


বুঝতে কিছুই বাকী নেই। ছোট্ট একটা কোনে! উপলক্ষ হয়তে। 
ঘটেছে।; হয়তো! চিঠি এসেছে একখানা, হয়তে। বাসায় কোনে। 
আত্মীয় কয়েক মিনিটের জন্তে পদক্ষেপ করেছিলেন । কিংবা ফিছুই 
ঘটে নি--সামনের আকাশটার মতে! আপনিই মেঘ এসে জমাট 
বেধেছে। আজ আর বাইরে থেকে উপকরণের দরকার হয় না, 
মনের-ব্ষিগ্রন্থি আপনিই লাল ক্ষরণ করে। 

মধ্যযুগের নাইটদের মতো! ধীরে ধীরে আসন্ন যুদ্ধের জন্টে 
তৈরী হল সুকুমার । বর্ণ-পর1 কিংবা ঘোড়া সাজাবার দরকার 
ছিল না, তার বদলে জামাটা খুলে ব্র্যাকেটে রাখল, হাত ঘড়িটা 
খুলে রাখল ড্রেসিং টেবিলের ওপর, ট্রাউজার ছেড়ে একটা! আধ” 
ময়লা ধুতি জড়িয়ে নিলে লুঙ্গির মতো, তার পর সম্ভার একটা 
আধপোড়া বর্মা চুরুট ধরিয়ে নিয়ে নিজেকে এলিয়ে দিলে ইজি 
চেয়ারে । 

বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়েও সব টের পাচ্ছিল অনুণ্রী। 
অথবা টের পাওয়ার দরকার ছিল না। প্রত্যেক দিনের এরা 
বাধা নিয়ম। ঘড়ির কাটার মতো! এক পথ ধরেই চলে । আট 
বছরে এ-সব মুখস্থ হয়ে গেছে অনুপ্রীর । 

সুকুমারই যুদ্ধের সুচনা করল। 

কথ! বলছ না যে? 

অনুত্রী হ'চোখে বিদ্যুৎ জ্বেলে মুখ ফেরালো৷ আবার । 

কী অপরাধ করেছি ৫তামার কাছে যে একদগড চুপ করে বসে 
থাকতে দেবে না? 

অপরাধের কথা হচ্ছে না।-_চুরুটট। যেমন বিশ্বাদ, তেমনি 
কড়া--নুকুমারের গলা জ্বলতে লাগল। সেই জ্বালাটার স্বাদ নিতে 
নিতে বিকৃত মুখে সুকুমার বললে, চুপ করে বসে থাকারও একট? 
ধরণ আছে। 

তুমি কি গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চাও ? 

ঝগড়া করতে চাই না। কারণটা জানতে চাইছি। 


কারণ কিছু নেই।_ চাঁপা নিষ্ঠুর গলায় অনুণ্রী বললে, আমার 
ভালে লাগছে না-_ভাই চুপ করে আছি। তাতে তোমার কি খুব 
অনস্ুবিধে হচ্ছে? বলো তা হলে, আমি ছাদে চলে যাচ্ছি। 

পীড়িত স্নায়ুঙুলেো আরও জর্জরিত হয়ে উঠছে স্ুকুমারের 1 
গলায় অসহ্য লাগছে চুরুটের ধোৌঁয়াটা। কেউ যেন উত্তপ্ত শিসের 
মতে! খানিকটা! তরল ধাতু ঢেলে দিচ্ছে সেখানে । সার! দিনের 
ক্লাস্তির পরে মানুষ বাড়ি ফিরে আসে শাস্তির আশায়, আশ্রয়ের 
সন্ধানে । .এই তার আশ্রয়, এই তার শাস্তি । সুকুমার ফাীত দিয়ে, 
নিচের ঠোট কামড়ে ধরল । 

খানিক চুপচাপ। কয়েকটা উত্তেজিত দ্রুত নিংশ্বাস পড়ল, 
সুকুমারের | 

অন্ুণ্রী বললে, হাঁত-মুখ ধুয়ে তোমার খাবারটা খেয়ে নাও। 
টেবিলেই ঢাক দেওয়া আছে। আমি চা করে দিচ্ছি উন্নুন ধরিয়ে । 

সুকুমার বললে, আমি খাব না। আমার খিদে নেই। 

বেশ, খেয়ো না তা হলে ।- নিরাসক্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলে 
আবার বাইরে চোখ মেলে দিলে অনুশ্রী ৷ 

সাড়ে ন'টায় সেই ছু'মুঠো খেয়ে অফিসে বেরিয়েছে। সার! 
দিন গেছে ঘাড়ভাঙা কাজের চাপ। বাড়িতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই 
তাকে এইভাবে আপ্যায়ন না করলে কী ক্ষতি হত অন্ুত্রীর? 
অন্ততঃ আধ ঘণ্টার জন্তে একটু স্বাভাবিক, একটু ন্গিগ্ধ হতে তার 
কী বাধা ছিল? মনের ভেতরে যত ভারই জমে থাক, কিছুক্ষণের 
জন্যে সামান্ত একটু অভিনয়ও সে কি করতে পারত না? একটুখানি 
খাবার, এক গ্লাস জল, এক পেয়ালা চা--সহজভাবে এগিয়ে দিলেই 
নুখী হত সুকুমার । এর বেশি দাবি তার আজকাল আর নেই-_ 
বেশি দাবি করবার উৎসাহও ন1। 

কিন্ত কী সংকীর্ণ _কী নির্মম হয়ে গেছে অনুত্রী। একবারও 
জিজ্ঞাসা করল নাঁ_কেন খাবে না, কি জন্যে খিদে নেই । . সুকুমারের 
কাছ থেকে আজ সে এত দূরে সরে. গেছে যে, একটুখানি সাধারণ 


৩৯. 


সৌজন্যও মে রাখতে চায় না । এই প্রাণহীন শীতল বরফের পিগুকে 
বুকের ওপর সে কতদিন বয়ে চলবে আর ? 

চুরুটটাকে ঘরের কোণায় ছু'ড়ে দিয়ে সুকুমার চেয়ার ছেড়ে উঠে 
সাড়ালে। | 

আমি একটু বেরুচ্ছি। 

চ1!খাবে না? 

না, প্রবৃত্তি হচ্ছে না। 

কোথায় যাচ্ছ ?--এবার অনুণ্রী উঠে দাড়ালো । তার মনের 
সম্পূর্ণ চেহারট। যেন ফুটে উঠেছে মুখের আয়নায়। ন্সেহ মায়া, 
কোমলতা--কোনো কিছুর চিহ্ন নেই সেখানে । সব প্রাগৈতিহাসিক, 
সমস্ত জাস্তব। 

নিজের মুখ দেখতে পেলে। ন! সুকুমার, কিন্তু তার ্ূপও অজানা 
নেই । ছুটো৷ অন্ধ প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি এখন। কে কাকে কতখানি 
ক্রুর আর কুটিল আঘাত দিতে পারে, তারই প্রতিযোগিতা 

চাপা গলায় সাপের মতো গর্জন করে সুকুমার বললে, যেখানে 
খুশি। এ ঘরে আর কিছুক্ষণ বসে থাকলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ 
হয়ে বাবে । খানিকক্ষণ পথে পথে ঘুরে আসব। 

নুকুমার বেরিয়ে যাচ্ছিল, অনুশ্রী এসে দরজা! আটকে দাড়ালো । 

একটা কথা শুনবে ? 

দাঁতে দাত চেপে সুকুমার বললে, বলো। 

রোজ এমনভাবে সিন ক্রিয়েটে করে লাভ কী?-_অনুশ্রীর 
শরীরটাও যেন ফণা তোল সাপের মতো তুলতে লাগল অল্প অল্প £ 
আমার জন্তেই নিজের ঘরে এসেও তুমি এক মুহূর্তের জন্যে শাস্তি 
পাও না। আমিই চলে গেলে কেমন হয় ? 

ঠিক তক্ষুনি পার্ক থেকে বেড়িয়ে ফিরে এল খুকু । দরজার সামনে 
ধাড়িয়ে দেখতে পেলো সব। সেই প্রতিদিনের পুনরাবৃত্তি আরম্ত 
হয়েছে। বাবা এখন তার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে, 
মাকে সে আর চিনতে পারছে না। একরাশ প্রবল কান্াকে 


শঁঠি৪ 


কোনোমতে সাহলে বিলে খুকু-ভার পর দিশকো সয়ে গেল, 
ছায়ার মতে] । 

সুকুমার দেখতে পেলে! খুকুকে-_কিন্ত খুকুর কথা ভাববার মতো! - 
মনের অবস্থা! ভার নয়। তখনে। অন্থপ্রী ফণা তোলা সাপের মতো 
ছুলছে তার সামনে । 

কী বলো তুমি 1 আমি চলে গেলে কেমন হয়? 

এ-কথা এর আগেও অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে অনুভ্ী, সুকুমার 
জবাব দেয় নি। কিন্ত আজ আর নিজের রাশ সে টেনে রাখতে 
পারল না। হাতের মুঠোয় রাখা দেশলাইট1 আঙুলের চাপে মটমট 
করে উঠল। সুকুমার বললে, ভালোই হয়--খুব ভালো হয়। 
তুমি মুক্তি পাও-_আমিও নিস্তার পাই এই নরক যন্ত্রণা থেকে। 

বারুদের পলতেয় ওইটুকু আগুনের জগ্তেই যেন প্রতীক্ষা করছিল 
অনুণ্্রী। চক্ষের পলকে মট করে ভেঙে ফেলল হাতের শখ! জোড়া 
_-হাঁড়ের টুকত্রার মতো। তার মেজের ওপর ঝরে পড়ল। তার 
পর পাগনসের মতো আচলের প্রান্তে সিথঘির সির ঘষে তুলতে 
তুলতে বলঙ্গে, বেশ, তোমাকে নিস্তার আমি দিচ্ছি। ইচ্ছে হয় 
লিগ্যাল সেপারেশনের জন্যে কোরে দরখাস্ত করতে পারো-_ন! 
করলেও ক্ষতি নেই। আর এক্ষুনি তোমার বাড়ি থেকে আমি 
বেরিয়ে যাচ্ছি। 

স্ুকুমারের হাতের মুঠোয় দেশলাইটা গুঁড়িয়ে গেল। অন্ধ 
জিঘাংসায় কাঠিুলোকে ছুড়ে ছড়িয়ে দিলে ঘরময়! এই মুহুর্তে 
একটা বীভৎস রকমের কিছু সে করে বসতে পারে । হাতের সামনে 
একটা খোল! ক্ষুর পেলে বনিয়ে দিতে পারে নিজের গলায়, একট! 
হাতুড়ি পেলে তাই দ্রিয়ে একঘায়ে নিজের মাথাটাকেই চুরমার 
করে দিতে পারে। 

থরথর করে কাঁপতে লাগল সুকুমার । কোনো কথা বলতে 
পারল ন!। 

একটানে একটা সুটকেস নামিয়ে আনল অন্ুত্রী। ডালা খুলে 


৩ ৪% 


ভেতরের ধা কিছু উবুড় করে ফেলল। বঝন্বন্‌ কঝে টুকরে!. টুকরো? 
হল একজোড়। চায়ের পেয়ালা । 

তবু কথা বলল ল! নুকুমার । কিছু বলবার চেষ্ট! করলে এখন 
কেবল চিৎকার বেরিয়ে আসবে একটা । সে চিৎকার মানুষের নয়। 

আর্শন! থেকে কতগুলো! শাড়ী, রাউজ টেনে নিয়ে তালগোল 
পাকিয়ে ঈুটকেসে ভরে ফেলল অন্ুশ্ী। 

আহি খুকুকে নিয়ে এক্ষুনি চলে যাচ্ছি। 

বার কয়েক ঠোট ছুটো কীাপবার পরে সুকুমার বোবা ধর 
আওয়াজে বললে, না, খুকু থাকবে আমার কাছে। 

থুকুকে রাখতে চাও ?-_রহস্তময় বিচিত্র হাসি হেসে অনুণ্তী 
বললে, বেশ, তাই রাখো । ওমায়ায় আমায় আর বাধতে পারবে 
না। জব সম্পর্ক চুকিয়েই আমি চলে যাব। 

এতক্ষণের মেঘে আচ্ছন্ন আকাশ থেকে এইবারে বৃষ্টি নামল। 
ঝমঝম করে নামল। 

দাতে দাত ঘষে সুকুমার বললে, যাওয়ার আগে ওয়াটারপ্রুফটা? 
নিয়ে যেয়ো! বৃষ্টি পড়ছে। 

ঠাট্টা করছ ?-__অনুণ্রী পাগলের মতো টেঁচিয়ে উঠল £ ওয়াটার- 
গ্রুফের কথ। মনে করিয়ে দিয়ে আমার আর উপকার করতে 
হবে না। ঝড়ের মধ্যেই খন বেরিয়ে পড়েছি--তখন এটুকু বৃষ্টিতে 
আমার কিছু আসে-যায় ন।। 

একট! তীব্র নীল ছ্যতিক্তে ড্রেসিং টেবিলের কাচ, অনুশ্রীর রক্ত- 
হীন হিং মুখ আর ঘরের চারটে সাদা দেওয়াল একসঙ্গে উদ্ভাসিত 
হল। বিকট শব্দ তুলে বান পড়ল কাছাকাছি কোথাও । 

আর অনুণ্রী বললে, শুধু যাওয়ার আগে খুকুকে একবার দেখে 
যাঁব। বৃষ্টিতে খুকু হয়তো পার্কের কোনে ছাউনির নিচে দাড়িয়ে 
আছে। সেইখানেই তাকে বলে যাব-_-তার মা মরে গেছে। 

আবার খানিকটা নীল ছ্যতি ঘরের মধ্যে লকলক করে গেল । 
এচণ্ড শব্দে বজ পড়ল আবার । 
৪২ 


তখন সুকৃমারের মনে পড়ল। 

খুকু ফিরে এসেছে। 

ফিরে এসেছে ?--হঠাৎ মুখের চেহারা বদলে গেল অঙ্ুত্রীর ১ 
তবে গেল কোথায় খুকু! এখন মেঘ ভাকছে- বাজ পড়ছে--খুকু 
কোথায় ? খুকু-খুকু-- 

খুকুর সাড়া এল না। 

অন্ুষ্ী ছুটে বেরিয়ে এল । খুকু বারান্দায় নেই, বসবার ঘরে 
নেই, রান্নাঘর, কলঘর, কোথাও নেই। 

সমস্ত ভুলে গিয়ে অনুশ্রী শক্ত করে সুকুমারের হাত চেপে ধরল । 
তাঁর পর আরও উন্মত্ত, আরও উদ্ভ্রান্ত গলায় ঠেঁচিয়ে বললে, বলো, 
আমার খুকু কোথায় ? বলো নে কোথায় গেল? 

স্বকুমারের কপালের ছ'ধারে রক্তের চাপে রগ ছটো প্রায় ফেটে 
যেতে চাইছে-_ন্ৃৎপিগুটা! ফুলে উঠতে চাইছে বেলুনের মতো! । হাত 
ছাড়িয়ে নিয়ে সুকুমার বললে, ব্যস্ত হয়ো না, আমি দেখছি। 

প্রায় তিন লাফে কুড়ি বাইশটা সিড়ি পার হয়ে স্বকুমার ছাদে 
উঠে এল। 

তীরের মতো বৃষ্টি পড়ছে। কালো কবন্ধ আকাশ থেকে বিদ্যুতের 
ঝিলিক। চশমার কাচ আবছা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বিভ্রান্তের 
মতো দাড়িয়ে থেকে তার পর সুকুমার দেখতে পেলে।। 

গ্গ! জলের ড্রামটার ঠিক পাশেই । একটি ছোট মানুষ লুটিয়ে 
পড়ে আছে। গোলাগী ক্রকট! লেপটে গেছে গায়ের সঙ্গে আর ছোট্ট 
মাথাটির কালে! চুলগুলি জলের একটা! শোতে যেন ভাসছে। 

খুকু! -_বুকফাটা আর্তনাদ করে ছুটে গেল সুকুমার । 
ছু'হাত দিয়ে খুকুকে তুলে নিলে বুকের ভেতর । ছোট শরীরটা 
ঠাণ্ডা আর শক্ত হয়ে গেছে-মাথাটা স্ুকুমারের কাধের ওপর 
ভেঙে পড়ল? 

আবার আর্তনাদ করে সুকুমার ডাকল : খুকু! 

ততক্ষণে অন্ুশ্রীও ছুটে এসেছে ছাদে । মাথার চুল খোলা, 


৪, 


আচল ঝুঁটিয়ে পড়েছে-_বাঘিনীর মতে ছুটে এসে স্বুকুমারের বৃক 
থেকে খুকুকে টেনে নিলে। 
একি! এ যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। খুকুখুকু। ওগো" খুকু কথ! 
কইছে না কেন? খুকুর কী হল 1 অন্ধুপ্রী হাহাকার করে উঠল। 
একটু আগেও সংযম হারায় নি সুকুমার--এখনো হারালো না । 
ক্ষেপে বললে, অজ্ঞান হয়ে গেছে। চলো-_নিচে নিয়ে চলো 
শিগগীর । 


ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন, ইনজেকশন দিয়েছেন, ভরসা দিয়ে 
গেছেন। কিস্ত ভরসা নেই স্বামী-স্জীর। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে 
খুকুর, মুখ টকটকে লাল। মাথার কাছে অনুস্্ী, আর বিছানার 
পাশে চেয়ার টেনে নিয়ে রাত জাগছে সুকুমার । 

ছুটো৷ আরক্ত বিহ্বল চোখ মেলল খুকু । শুহ্য দৃষ্টি ফেলে কী 
যেন দেখছে । 


অনুত্ী ডাকল £ খুকু-_ 
খুকু জবাব দিল না। ভীত অস্বাভাবিক চোখে তখনে। কী 
'যেন খুঁজছে সে। 


নৃকুমার খুকুর জ্বরতপ্ত কপালে হাত রাখল। তীব্র উত্তাপে 
শিউরে উঠল শরীর । 

খুকু-খুকু-. 

খুকু কথা কইল। বিড়বিড় করে বললে, যাব না, আমি ঘরে 
যাব না 

থুকু-মা আমার, মাণিক আমার--অনুণ্রী কীদছে। 

খুকু প্রলাপ বকতে লাগল £ যাব না, আমি ঘরে যেতে পারব 
না। কেন রাতদিন ঝগড়া করো তোমরা ? কেন বাবা না খেয়ে 
অফিসে যায়? কেন মা এমন করে কাদে? আমি যাব না 

নিঃশ্বীন ফেলে খুকু পাশ ফিরল। 

বাছিয়ে ৰিরবিরিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বজ বৃষ্টি আর নেই এখন, 


আকাশের কাঁক্সার পালা চলছে। দীর্ঘস্বাসের মতো হাওয়া এসে 
শব্দ তুলছে জানলার খড়খড়িতে ৷ 

বুকুমার অনুভ্রীর দিকে তাকালো । কোমল গলায় ডাকল, অনু 

অনুণ্রী জল-ভর1 চোখ তুলল । 

খুকুর গায়ের ওপরে রাখা অনুণ্রীর হাতখান। মুঠো করে ধরল 
সুকুমার । আন্তে আত্তে বললে, এ আমর! কী করেছি অন্থ? 
আমাদের পাপের দণ্ড এ কাঁকে বইতে হচ্ছে ? 

সেই বজ্র, সেই বিদ্যুতের উদ্ভাস মুহুর্তে একট! নগ্ন নিষ্ঠুর 
সত্যকে উদঘাটন করে দিয়েছে। ছু'জনের সমস্ত বিষ অঞ্জলি 
পেতে তিলে তিলে নিয়েছে খুকু-_সেই বিষের জ্বালায় এই ছোট 
মেয়েটাই নীলকণ হয়ে গেছে । অন্ধ, অর্থহীন মনোবিকারে আচ্ছন্ 
চোখ নিয়ে ওরা কেউ এতদিন তা টেরও পায় নি। বুঝতেও 
পারে নি, দিনের পর দিন ওর1। কেমন করে সবচেয়ে নিরপরাধকে 
সবচেয়ে নির্মমতার আঘাতে জজরিত করে তুলছে। 

অনু, এবার আমাদের প্রায়শ্চিত্তের পালা ।-_অনুণ্রীর হাতে 
চাঁপ দিয়ে আবার ক্লাস্তঃ কোমল গলায় বললে সুকুমার | 

অনুণ্ী জবাব দিল না। জবাব দেবার দরকারও ছিল ন1। 
আুকুমীরের হাতের ওপর টুপ. করে এক ফৌঁট? চোখের জল বরে 
পড়ল, অনুপ্রী সমস্ত অনুতাপ, সমস্ত বেদনা আর সমস্ত মমত। 
মাখানে। গলায় প্রার্থনার মতো উচ্চারণ করল : খুকু--আমার 
মা"-আমার মা-মণি-- 


৪৫. 





অন্ত্যেষ্টি 


একক্জন অভিনতা। মারা গেছেন । তার শোকধাত্রা এসে পৌছেছে 
নিমতলার শাশানে। 

অবশ্য মৃত্যুর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। ওটা চিরদিন ঘটে 
এসেছে, চিরদিনই ঘটবে এবং আজকে যিনি মার গেছেন তিনি 
অভিনেতার আদর্শ মৃত্যুই বরণ করেছেন ।, 

অর্থাৎ কয়েক বছর আগে খ্যাতি আর গৌরবের শিখরে 
উঠেছিলেন তিনি। প্রীয় প্রতি সপ্তাহেই কোনে! না কোনো 
সিনেম। লাপ্তাহিকে তার ছবি বেরুত, তিনি কোন্‌ হোটেলে খেতে 
ভালোবাসেন কিংবা কোন্‌ দরজীর দোকানে স্যুট তৈরি করান 
তার বিশদ বিবরণ থাকত। তার পর একদিন জান! গেল, তাকে আর 
পাঁবলিক' চায় না-তার আর বকৃস অফিস নেই। রোজগার 
কমে আসতে লাগল--এখন আর কন্ট্রাকট ফেরত দিতে হয় না, 
কন্ট্রীকটের জন্তেই ঘোরাঘুরি করতে হয়। এর মধ্যে শরীরে 
ভাঙন শুরু হয়েছে-লিভারে প্রায়ই ব্যথ! উঠতে আরস্ত করে 
দিয়েছে। অভিনেতা বিছানা নিলেন। অভিজাত মহলের বাড়ি 
ছেড়ে দিয়ে আস্তানা নিলেন প্রায় বস্তির ঘরে । ছু'চারজন 
সমব্যথী বন্ধু যখন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে এলেন, তখন আর 
করবার মতে? বিশেষ কিছু অবশিষ্ট ছিল না। স্ত্রী এবং ছুটি 
নাবালক ছেলেকে পথে বসিয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় ভদ্রলোক 
মার গেলেন! 

একেবারে ফরমূলা মাফিক মৃত্যু! জ্যামিতির সিদ্ধান্ত ! 

শ্শানঘাট লোকে লোকারপ্য । কম করেও হাজার খানেক 
লোক ভেঙে পড়েছে ভেতরে । বাইরে দাড়িয়ে আরও হাজার দশেক । 
একট প্রবল কোলাহল উঠছে। ভেতয়ে খবরের কাগজের লোক 
ঘুরছে । ক্যামেরার ফ্ল্যাশ চমকে উঠছে দিনের আলোতেই। 


5৬ 


অটোগ্রাফের খাতা ইতস্তত ঘুরে বেড়াজ্ছে। হাপির আওয়াজ 
উঠছে থেকে থেকে--শ্মশানের অভ্যন্ত গন্ধ ছাপিয়ে হাওয়ায় 
হাওয়া ছড়িয়ে পড়ছে দার্মী সিগারেটের ধেয়।। যেন উৎসবেন্র: 
একটা পরিবেশ স্যপ্টি হয়েছে চারদিকে । 

অভিনেতা কি জানতেন_ মৃত্যুর পরে এমন বিপুল সম্বধনা 
জুটবে তার কপালে? জীবনের শেষ ছ'মাস মাত্র ছ'একটি 
নিতাস্ত অস্তরঙ্গ ছাড়া তার পাশে কেউ এসে দাড়ায় নি--শেষ- 
কৃত্যর এ সময় সৌভাগ্য তিনি কি কল্পনার্ড করেছিলেন? 

অভিনেতার আজ আর চোখ মেলে চাইবার উপায় নেই। 
অন্ধকার কালো কোটরের ভেতরে, বিবর্ণ পাতার ছায়ায়, তার 
দৃষ্টি চিরদিনের মতো মুছে গেছে। নইলে চারদিকে তাকিয়ে 
তিনি হয়তে। প্রচণ্ড কৌতুকে হা"হা করে হেসে উঠতেন একবার । 

দশ হাজার লোকের ভিড় জমেছে তার জন্যে নয় । 

তাঁর শোক-যাত্রায় পায়ে হেঁটে এসেছেন চিত্র গগনের অনেক 
চন্ত্র-কৃর্য-তারা । মোটরে চেপে পেছনে পেছনে এসেছেন চিত্বহারিণী 
চিত্র-নায়িকার দল। এতগুলো মানুষ জড়ো হয়েছে তাদেরই 
দর্শন-লাভের আকাঙ্ায়। কেউ কেউ অটোগ্রাফ নেবে- একটু 
দুঃসাহসী যারা, তাদের ফটে। তোৌলবারও বাসন রয়েছে মনে মনে । 

রাশি রাশি ফুল দিয়ে সাজানো শব নামানো রয়েছে একপাশে । 
কে যেন একটুখানি চন্দনও পরিয়ে দিয়েছে গালে-কপালে । একদার 
রাজপুত্র । প্রেমের দৃশ্যে তার অভিনয় দেখে হাততালিতে ফেটে 
পড়ত প্রেক্ষাঘর । বীরবেশে ঘোড়া ছুটিয়ে ভিনি যখন চলে 
যেতেন, তখন অনেক তরুণীই তাদের বুকের ভেতর অনেকক্ষণ ধরে 
সেই ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেত। 

আজ সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। বিবর্ণ, জরাজীর্ণ 
চেহারা । কোনে! এক নিতান্ত নগণ্য হরিপদ কোরানীর' সঙ্গে 
তার মৃতদেহ বদল করে নিলেও লে পার্থক্য সহজে ধর পড়বে 
না লোকের চোখে। 


টি 


একফন ক্ষঘ্িনেত্রীর চোখ ছল-ছল করে উঠল । তার ভাগ্যে 
এখন তুঙী বৃহস্পতি চলছে। 

ইস্‌-ধ-কী চেহারখ হয়ে গেছে গুর। চেনাই “মুশকিল । 

পাশ থেকে একজন মাঝারি অভিনেত। চাটুকারের মতো মাথা 
নাড়লেন, 'দত্যি! লা বঙ্গে দিলে যেন বোঝাই যায় না।! 

অভিনেত্রী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ম্বতের মুখের দিকে । 

“আমার প্রথম বইভে ওঁর এগেনস্টে আমি নেমেছিলুম । 
উঃ--কী ম্যান্লি চেহারা_কী বর্ম! আমি তে! সামনে দীড়িয়ে 
প্রায় কেঁপে-কেপে অস্থির, ডায়ালগ বল! দূরের কথা! মনে 
আছে একটা শটে পর পর চারটে এন্জি করেছিলগুম। ভাবতে 
পার] যায়-_-এ সেই লোক ? 

মাঝারি অভিনেত1 বললেন, “যা বলেছেন ! তবে ব্যাপারটা কী 
জানেন? সেই যে, যে জন দিবসে মনের হরযে--আর কি! আমর! 
কতবার বুঝিয়েছি, অত খাবেন না--সব জিনিসেরই একটা সীম! 
আছে। উত্তরে বলত কী, জানেন ? আমি. বামুনের ছেলে--অগস্ত্যের 
বংশধর। চুমুক দিয়ে সমুদ্র শেষ করলেও কিছু হবে না আমার 1 

একট! কথা চেপে গেলেন তিনি । মৃৃত-মানুষটির দৌলতে বিন? 
পয়সায় বিস্তর নেশা! তিনিও করেছেন--হোটেল থেকে মনিব্যাগ 
শুন্য করে বেরিয়ে আসার সতকাজে ভদ্রলোককে তিনিও কম 
সহঘোগিত1 করেন নি। 

অভিনেত্রী বললেন, চগ্জুন হাবুলবাবু, এখানে আর নয়। বড্ড 
বিশ্রী লাগছে ।' 

এদিক ওদিক নানা! ছোটখাটো দলে জটলা চলছে। আর 
একজন নামকরা অভিনেত্রী হঠাৎ দেখা পেয়ে গেছেন তীর এক 
ভূতপূর্ব প্রোভিউসারের । চার দিনের প্রোরেটার টাকা মেরে 
দিয়েছেন প্রোডিউসার- বহুদিন চেষ্টা করেও অভিনেত্রী তা আদায় 
করতে পারেন নি-দেখাই পান নি লোকটির । আজকে জায়গা 
মন্কো পেয়ে চেপে ধরেছেন । 
' ৮ 


ওকি মিস্টার চাকলাদার, পালাচ্ছে কেন চোরের মতো! £ 
আমাদের বুবি চোখেই দেখতে পান না আঙ্গকাল 1 

ধরা পড়ে পাংশু হয়ে গেছে মিস্টার চাক্লাদদারের যুখ। তকু 
দেই অবস্থাতেই খানিক বিনয়-বিগলিত হান্ত করলেন তিনি। 

“কী যে বলেন, আপনাদের দেখতে পাইনে | বাপরে! ছ” 
চোখ জুড়ে আপনারাই তে! বিরাজ করছেন ।, 

লক্ষণ দেখে তা তে! মনে হচ্ছে লা। স্ুুটু করে পাশ 
কাটিয়ে পালাচ্ছিলেন-- 

“পা-পা-পালাই নি তো”_চাকৃলাদার কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা 
করলেন £ “সত্যি বলছি গায়ত্রী দেবী, ভাবলুম আপনি এদের 
সঙ্গে কথ কইছেন, তাই আর বিরক্ত করব না 

কাচভাঙার মতো! আওয়াজ তুলে তীক্ষ নিষ্ঠুর গলায় গায়ত্রী 
দেবী হেসে উঠলেন । 

কিন্তু আপনার। মাঝে মাঝে বিরক্ত করলে আমরা ফে 
বেঁচে যাই ! সেই ধপ্রাণে'্রাণের” টাকাটা, 

চাকৃলাদার এবারে একদম স্তন্ধ। তার পরে খানিক কাষ্ঠ হাসি 
হেসে বললেন, “আমার নতুন ছবিটা রিলিজ করলেই দিয়ে দেব__ 
সত্যি বলছি! পর পর হ'খানা বই মার খেলো» বড্ড টাইটে 
পড়েছি এখন-_+ 

আর এক পাশে একজন ছোকরা ডিরেক্টার দাড়িয়ে ভক্তির 
অর্থ নিচ্ছেন। তার নতুন ছবিখান! “ন্ুপারহিট্‌” হয়েছে--কয়েকজন- 
চেপে ধরেছে তাকে । 

একজন প্রৌঢ় একস্ট্রা বিধিমতে। ভোয়াজ করছেন । একস্ট্রাটি 
কুড়ি বছর এ লাইনে ঘোরাঘুরি করছেন, স্ত্রীর গয়না বেচে বনু 
ডিরেক্ীরকে খাইয়েছেন, কিন্তু কখনো! কোনো বইতে পীচটার 
বেশি ডায়ালগ পেলেন না । ফিল্ম-লাইনের তিনি সবজনীন মাম! । 

মামা বলে চলেছেন, 'বুধলে হে প্রদোষ-এ বয়সে অনেক 
ডিরেক্টারই তো চরালুম। কিন্ত হক কথা বলতে কি, তোমার 


82৮ 


এই নাঁহুন ছবিতে অনেক জাদরেল মিঞার তুমি কান 
কেটে নিয়েছ! তাই তো বলি, নিউ ব্লাড চাই--চাই নতুন 
প্রুতিভা-+- 

ডিরেক্টার প্রসন্ন হয়ে একটা আমেরিকান সিগাক্সেটের প্যাকেট 
বের করটুলন। আগে “চার মিনার” খেতেন, বলতেন, ওটা নিজাম 
ত্র্যা্ত_-ছ্থায়দ্রাবাদের আযরিস্টোক্র্যাসি। হালে ভিনটে বড় বড় 
কন্ট্রান্ট পাওয়ার পরে হলিউড আ্যারিস্টোক্র্যাসির দিকে পা 
বাড়িয়েছেন। 

“আনুন মামা, সিগারেট নিন? 

দ্বিতীয়বার বলবার দরকার ছিল না। মামা! প্রায় ছে দিয়েই 
সিগারেট তুলে নিলেন । 

“কিন্ত এবার আমাকে একটা বড় পার্ট দিতেই হবে__নইলে 
ছাড়ছি ন!। শুনেছি “মুন শাইন লিমিটেডের বইটাতে একটা 
দাছর পার্ট রয়েছে--ওট1 এবার দিয়েই দেখো না আমাকে । 
নতুন টাইপ করে দেব-_বিলিভ মি-_; 

ডিরেক্টার মুছু হাসলেন। 

“রি মামা, ওটা 'অল্রেডি মহিমবাবুকে দেওয়া হয়ে গেছে। 
পার্টি আবার অল্-স্টার-কাস্ট ছবি চায় কিনা! যাই হোক, আপনার 
কথা মনে রইল। স্টুডিওতে একদিন দেখা করবেন_ 

আর-একদিকে একজন দিকৃপাল অভিনেতাকে ঘিরে ধরেছে 
একদল অটোগ্রাফ-শিকারী'। উদ্বারভাবে তিনি খাতার পর খাতায় 
সই দিয়ে চলেছেন, বাণীও দিচ্ছেন সেই সঙ্গে। 

বাংলাদেশের ফিল্ম ইগ্ডাস্ট্রি ? অন্ধকার-_তার ভবিষ্যৎ একেবারে 
অন্ধকার । 

“তবে কি আপনি বন্বের কথা বলছেন স্যার ?-_একটি ভক্তের 
দ্রিজ্ঞাপা শোনা গেল। ছৃ'বছর আগে পর্বস্ত দিকৃপাল বন্ধের 
বন্দনায় পঞ্চমুখ হতেন, কিন্ত সম্প্রতি মত বদলেছেন।' ছ'খানা 
ছবির কন্ট্রীকট নিয়ে বন্ে ছুটেছিলেন, কিন্ত ছুটি বই-ই ফ্লপ. 


*৬ 


হয়েছে। আত তার পরেই দিগুণ বেগে ভিবি ফিরে এলেছেদ 
কলকাতায়--ঈশ্বরেচ্ছায় এখানে তীয় বাজার আছে এ্রখনে1। 

চটে গিয়ে দিকৃপাল বললেন, “বন্বের ছবি? ই্্যাশ! যেন 
পাগলের কারখানা--না আছে মাথামুঙ না আছে লজিক! ওরাই 
তো দেশের সর্বনাশ করলে মশাই 1, 

কিন্ত ওদের টেকৃনিক্যাল্‌ কোয়ালিটি-_. 

টেকৃনিক্‌ সম্বন্ধে কিছু না বুঝলেও কথাটা বলতে হয়---অস্তত 
এইটেই রেওয়াজ । ভক্ত একটা ভালো কথা বলবার সুযোগট! 
ছাড়তে পারল না। 

“টেকনিক্যাল কোয়ালিটি? ই--য়েস 1,ধীতে চেপে প্রতিধ্বনি 
করলেন দিকৃপাল : গ্ঘাট্স্‌ ট্র,। কিন্তু ব্যাপারটা কি জানো? 
উপমা দিয়ে বলি। কোনো পরম! সুন্দরী মেয়ের যদি এক বিন্দুও 
ব্রেন না থাকে, তা হলে কি রকম ঈাড়াবে 1 ঠিক তাই-- 

গঙ্গার ঘাটে জোয়ারের ঘোলা জল এসে ঘা দিচ্ছে । চিতার 
একরাশ পোড়। কয়লা ভেসে চলেছে আোতে। অভিনেতা দভ্িদার 
জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন দার্শনিকের মতো । 

আযসিস্ট্যাপ্ট ডিরেক্টীর সোমেন এগিয়ে এল তার কাছে। 

“কী ভাবছেন দক্তিদারদ। ? 

“ভাবছি, মরে গেল লোকটা ? 

গেল বই কি।_ লোমেনও উদাস হয়ে উঠল £ “আমাকে বড় 
'ভালোবাসত | হাসপাতালে যখন সেদিন দেখ! করতে যাই, আমাকে 
বলেছিল-_তুই ডিরেক্টার হলে তোর বইতে আমাকে একটা রোল্‌ 
দিদ সোমেন । বলেছিলাম, তুমি আগে সেরে ওঠো দাদা 
রোল দেব বইকি। উত্তরে বলেছিল, সেরে উঠব বই কি-_-আমি 
কি আর চিরদিন পড়ে থাকব এখানে ! দেখিস, এবারে ভালো 
হয়ে সেন্সেশন স্য্টি করব চারদিকে । কত জিনিস করবার 
আছে, কিছুই তো কর] হল না।' 

সোমেনের গল। ভারী হয়ে উঠল। অল্প বয়েস, তাই স্টুভিয়োর 


১ 


বন্ধ হারা আর হাজার হাজার কিলোওয়াটের আলোতেও এখনে! 
তাঁর মনের সবুজ রঙ গুকিয়ে হলদে হয়ে যায় নি। 

দত্তিদরার দীর্ঘশ্বাস ফেলল । 

না, কিছুই করা হল না ।”_-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে দন্ডিদার 
বঙ্সলে, পমাজকে ওর মরা যুখের দিকে তাঁকিয়ে আমার কী মনে হচ্ছে 
জানিস প্লোমেন? ওর মতে! আমিও একদিন অমনি টপ. করে মরে যাব। 

“ছিঃ ছিঃ দক্ভিনারদ] 1, 

“ঠিকই বলছি সোমেন । আমারও প্রায়ই পেটে ব্যথা উঠছে 
আজকাল-_ভালে! ঘুম হয় না, খেতে পারি না, 

ছেড়ে দিলেই তো। পারেন। পয়সা খরচ করে কেন নিজের 
সর্বনাশ ডেকে আনেন ? 

ছাড়তে তো! চাই, কিন্তু পারি কই! _ভূতগ্রস্তের মতো 
বিহ্বল চোখে চেয়ে রইল দস্তিদার ঃ$ “সব বুঝেও তো ফিরতে 
পারছি না! অথচ বুড়ো মা এখনো বেঁচে আছেন, স্ত্রী ছেলেপুলে ! 
নাঃ ওর ম্বত্যু দেখে আমার শিক্ষা হয়ে গেল। কাল থেকে আর 
চৌরঙ্গীর রান্ত। মাড়াব নাঁ_+ 

সোমেন জবাব দিল না। দস্তিদারকে সে জানে । আজ 
সন্ধ্যার পরেই এ শ্মশান বৈরাগ্য মুছে যাবে তার মন থেকে। 

ঘাটের ওপাশে আর-একদল আড্ড। বসিয়েছে । একটি কমেডিয়ান, 
ছুটি ছোকরা অভিনেতা, জন ছুই টেকৃনিশিয়ান। একজন বুড়ো 
প্রোডাকশন ম্যানেজার বর্সেছেন সভাপতি হয়ে । 

কমেডিয়ান একট! বিখাত গানের প্যারডি ধরেছিল, সভাপতি 
তাকে থামিয়ে দিলেন। 

“এই, কী সুর ধরেছিস! শ্মশানে এসেছিস শোক করতে-_ 
ওসব ছেলেমানুষী দেখলে লোকে কী বলবে ? 

“শোক করার জন্ভে বিস্তর লোক জুটেছে দাদা, আমাদের 
অংশে একটু ঘাটতি পড়লেও কেউ কিছু মনে করবে না1। তুমি 
ছার এমন রসের মধ্যে বাগড়া দিয়ে না)? 


৫২ 


“আরে, বাগড়া দিচ্ছে কে? অত না-র্টেচালেই তে! হয়।, 
ভাখনা-_দত্তিদার কেমন ভাবুকের মতে! বসে রয়েছে? | 

'গাতেক কবুতর খেয়ে নিছে অন --একজান বুম্যান্‌ 
যোগান দিলে। . 

সভাপতি বলেন, ছোড়ে € দে ওর রা, হারে, রসের কথা 
বলছিস, রসের খবর কী রাখিস তোরা 1 ইতিমধ্যে তোদের 
পুবালি দেবী কী করেছে জানিস? পরশু প্লেজার হোটেলে” 

সবাই ঘন হয়ে বসল। 

“সঙ্গে কে ছিল দাদা? আমাদের সেই পপ্রন্স' নাকি ? 

শুধু প্রিজম? সেই সঙ্গে আরও জন ছুই পাঞ্জাবী কাণ্তেন। সবাই 
মিলে যা একখান হুল! হুলা ড্যান্স শুরু হল-_-. 

“খোলসা করে৷ দাদা, খোলসা করো । জমাও---, 

ঘাটের ধারে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। 
যৌবনের সীমান্তে তার বয়েস, প্রায় পাচ বছর আগে কফিছ্পা- 
লাইন থেকে বিদায় নিয়েছে সে। বড় পার্টে কেউ তাকে এখন ডাকে 
না_ছোট পার্টেও নামতে পারে না চক্ষুলজ্জায়। আজকাল প্রায় 
অনাহারেই তার দিন কাটে । 

যে মানুষটিকে আজ শ্মশানে আনা হয়েছে, তার সঙ্গে বহুবার 
অভিনয় করেছে সে। শুধু অভিনয়ই করে নি, তাকে সে ভালোবাসত। 

পাকের থেকে উঠেছিল-মস্থণ পথ দিয়ে চলার সুযোগ 
পায় নি, তবু-_তবু ওই মানুষটিকে সে জীবনের আকম্মিক আগন্তক 
বলেই ভাবতে পারে নি! ওর কাছে যতবার ধরা দিয়েছে তত- 
বারই মনে হয়েছে যেন সমস্ত গ্লানি মুছে গেছে তার, যেন 
নিজেকে ওর কাছে উজাড় করে দিয়ে ধন্য হয়েছে সে। যেদিন 
নেশা কেটে যাওয়ার পরে ও চিরতরে বিদায় নিল, সেদিনও 
ওর স্মৃতিকে বুকের মধ্যে রেখে পুজে! করেছে সে। 

টপ টপ, করে জল পড়ছে মেয়েটির চোখ দিয়ে--দৃষ্টি ঝাপসা 
হয়ে আসছে ! 


€৩ 


আর ছুটি মানুষ অপেক্ষা করছে কেওড়াতলার শ্মশানে । 
'নিমতল! থেকে অনেক দূরে । 

একজন অভিনেতার স্ত্রী। পরনে মলিন লাল পাড় শাড়ী--_ 
নীর্ণ হাঁতে শেষ সম্বল ছুটি শাখা, এখনে। ভাঙা হয় নি- এখনো? 
কপালে সি'ছরের ফোটা জ্বলজ্বল করছে। পাশে শুকনো মুখে 
বসে আছে চার বছরের ছেলেটি । ্‌ 

বড় ছেলে গেছে শবধাত্রার সঙ্গে । 

কথ। ছিল শবধাত্রা আসবে কেওড়াতলায়, শেষ পর্ধস্ত মত 
বদলেছেন কতৃপক্ষ । কিস্ত সে খবর কেউ তাদের জানায় নি, 
হয়তে। খেয়ালই হয় নি কারো । 

বেলা নট! থেকে তারা অপেক্ষা করে আছেন। তাদের 
শোকাতুর-ক্ষুধাতুর গীড়িত চোখের সামনে সমস্ত শ্াশানটা যেন 
ছায়াবাজির মতো! নাচছে। মাথার ওপরে স্ষ আগুন ছড়াচ্ছে 
শ্মশানের ধোয়া আর হর্গজ্ধ একটা শ্বাসরোধী আবেইন স্থষ্টি 
করছে তাদের চারদিকে । 

বেলা ছুটো বেজেছে এখন । 

চার বছরের ছেলেটির মাথা ঘুরছে, সে আর থাকতে পারছে 
না। একবার শুধু ক্ষীণ কণ্ঠে বললে, বড় খিদে পেয়েছে মা, বাড়ি 
যাবে না? 

মা শুনতে পেলেন না। আর শুনলেই বা কী হত? আজ 
একটি দানাঁও খাবার নেইপ্বরে। 


৫৪ 


বাঁড়ি বদল 

শেষ পর্যন্ত বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল এপ্টালীর দ্িকটায়। 

মনের মতো! বাড়ি । অর্থাৎ এরা যেমন চাইছিল ঠিক সেই 
রকম। তেতলায় তিন ঘরের একটি নতুন ফ্ল্যাট । দক্ষিণ-পুব- 
পশ্চিম তিনদিকেই খোলা । দক্ষিণ-পুব হ'ধারেই ছটি ছোট বারান্দা 
রয়েছে। নানের ঘর সম্পর্কে ললিতার একটু সৌখিনতা আছে--- 
সেটিও বেশ পছন্দসই, ঝণাঝরির ব্যবস্থা আছে। 

ভাড়া? একেবারে মারাত্মক কিছু নয়। একশে। কুড়ি টাকা । 
একটু কষ্ট হলেও দেওয়া চলবে। তা ছাড়! মাস ছয়েকের মধ্যেই 
বেশ ভালো! একটা লিফটের আশা আছে শৈলেনের । তখন আর 
বিশেষ কিছু অস্থবিধে হবে না । নাঃ-নিয়েই ফেল! যাক। এমন 
সুযোগ সহজে আসে না । 

ললিতা বললে, দালালকে একশো কুড়ি টাকা দ্রিতে হবে ? 

শৈলেন বললে, কী আর কর! যায়? কথাই তো আছে, 
সেই রকম। 

বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে না? 

এক মাসের বাড়ি ভাড়া ওঁকে দিতে হবে-সেই রকম চুক্তি 
ছিল। ভদ্রলোক খেটেওছেন কম নয় ! 

ললিতা জবাব দিল না। বোঝা গেল, খুশি হয় নি। মাঝখান 
থেকে কে-একটা লোক এসে এক মুঠে। টাকা নিয়ে চলে যাবে, এ 
ব্যাপারটাকে সে কিছুতেই সহা করতে পারছে না। 

শৈলেন বললে, তা হোক। ও নিয়ে মন খারাপ কোরো না। 

ললিত! শুকনে। হাসি হাসল । 

মন খারাপ করেই বাকী করব! কথা যখন দিয়েছ, তখন 
দিতেই হবে। 


১. 


খোঁচা যে এক-আধটু শৈলেনেরও না বি'ধছিল তা নয়। আপাত 


'শোকটা ভোলবার চেষ্টায় একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বললে, তা 
হাজেও ঝাড়িটা চমতকার । একেবারে মনের মতো । আমর] এতদিন 
খরে গ্নেমনটি চাইছিলাম ঠিক তাই। বড় নাস্তার কাছে-_অথচ 
ঠিক ওপরে নয়। রাতদিন কানের কাছে বাস ট্রামের ঘড়ঘড়ানি 
শুনতে হবে না। সকাল থেকে সন্ধো পর্যস্ত রোদ পাওয়া যাবে”” 
রাত্তিরে ঘরে চাদের আলো পড়বে, দক্ষিণের বাতাস আপনে । 

লঙ্লিতা বললে, তা তো৷ আসবে। কিন্তু বাঁড়িওলা বাড়িতেই 
থাকে বলছিলে ন1? 

তাথাকে। থাকে দোতলায়। বাড়িওল! নন-_বাড়িউলী। 

বাড়িউলী 1--ললিতা ভ্রকুঞ্চিত করলে । 

ভন্্র মহিলা বিধবা । ছেলে নেই--আছে গুটি তিনেক মেয়ে। 
একতলা তেতল! ভাড়া দেন-_-ওই ভাড়ার টাঁকাতেই তার কোনো 
সতে চলে । 

কত বড় মেয়ে 1-_-ললিতার দৃষ্টি জিজ্ঞাস হয়ে উঠল । কেমন 
অন্বস্তি লাগল শৈলেনের ৷ 

একটি বি-এ পড়ে, আর ছুটি স্কুলের ছাত্রী । 

ও। 

একটুকরে। হালকা মেঘকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে 
শৈলেন বললে, সিঁড়ি আলাদা-__কোনে। সম্পর্ক নেই। 

ললিত! বললে, তা বটে। তবু বাড়িওলার সঙ্গে এক বাড়িতে 
থাকা! কথায় কথায় খিটিমিটি বাধতে পারে। তা ছাড়া বাড়ি- 
উলী আরও ডেন্জারাস্! সব সময়েই নাক উচু করে থাকবে। 
বিধবার আবার ছত্রিশ রকমের ফ্যাসাদ--হয়তো৷ একদিন মুরগীর 
পালক উড়তে দেখলে-_ 

নান্না) সে সব কিছু নেই। ভদ্রমহিল! বেশ কালচার্ড। 

তাহলে আর বলবার কী আছে। যেমন চাওয়! গিয়েছিল-_. 
দালাল ভদ্রলোক ঠিক তেমনটিই ছুটিয়ে দিয়েছেন। এর পরে 
পখ্ত 


সি 


পর্ণমোৎসাহে বাক্স প্যাটর। গুছিয়ে নিতে যা দেরি। তবু ললিত! 
পকেমন গম্ভীর হয়ে রইল । 

শৈলেন বললে, তা হলে আজই ভাড়াটা দিয়ে কণ্টাক্‌ট্‌ 
করে আদি । 

আজই ? 

আরও অনেকে ঘুরছে তো। আজকের ভেতরে সেল ন৷ 
করলে উনি অন্ত কাউকে দিয়ে দেবেন। তা ছাড়া পয়লা তারিখে 
বরাড়ি বদলাতে হলেও তো সাতদিনের বেশি সময় নেই। 

সাতদিন ?-_-ললিত। চমকে উঠল £ এর মধ্যে কী করে হবে? 

শৈলেন হাসল £ কেন হবে না? এত কি ফালিচার আছে 
আমাদের যে সরাতে তিনদিন লাগবে? ও তো একটা লরীর 
মামল।-_-এক ঘণ্টার ব্যাপার । 

আর চিঠিপত্র ঘা কিছু এ ঠিকানায় আসবে? 

পোস্টট আপিসে খবর দিয়ে রাখব। ওখান থেকেই র্রি- 
ডাইরেক্ট করে দেবে। 

ললিতা আরও কিছুক্ষণ চুপ ক'রে রইল। তারপর আস্তে 
আস্তে বললে, বেশ, সেই ভালো । 

শৈলেনেরও যে খুব ভালো লাগছিল তা নয়। 

অনেকদিন হয়ে গেল এ-পাড়ায়, প্রায় বারে। বছর। এই অন্ধ 
গলিতে এসে যখন ওরা ঢুকেছিল, তখন যুদ্ধ চলছে কলকাতায় । 
একতলায় একখানা এদেো ঘর যোগাড় করতেও তখন হাজার টাক! 
খসেলামী দিতে হত । সেই সময় এ বাড়ি যোগাড় করেছিল ললিতাই। 
তার এক সহপাঠিনী বান্ধবীর স্বামী খুঁজে দিয়েছিলেন । 

পুরোনো দোতল। বাড়ি। দিনের বেলাতেও উঠোনট। পর্যস্ত 
অঞ্ধকার। সামনে একটা মুখ-খোল! কল, ত1 দিয়ে ছর্ছয় করে 
একটানা জল পড়ছে । নিচের ঘরগুলোর শ্যাওলাধরা কালো কালো 
'দেওয়ালগুলে। দিয়ে ফৌটায় ফোঁটায় জল গড়ায় বলে মনে হয়। 
পুলিস কোটের এক উকিল তার বাসিন্দা । ওকালতি করে ভঙ্গলোক 


৪ ৭ 


বিশেষ সুবিধে করতে পারেন নি--পাড়াক় মুদ্ী সময়ে অসময়ে 
তাগাদা করে যায়-_তার ভাষাটা কখনে। কখনে। খুব মোলায়েম বঙ্গে 
মনে হয় না। তবে লক্ষ্মীর কপা না থাকলেও যষ্ঠটী ঠাকরুণ অনুগ্রহ 
করেছেন- পাঁচ ছ'টা ছেলেপুলে। তাদের শিক্ষা-দীক্ষা কি রকম 
হচ্ছে--সে কথ! বলে লাভ নেই- কিন্তু পাড়ায় ফল বা! খেলন! নিয়ে 
ফিরিওলা ঢুকলে কিছু না কিছু হাত-সাফাই তারা করেই। ধরাও 
পড়ে মধ্যে মধ্যে। তখন বাপ তাদের সকলকে পাইকিরি দরে 
প্রহার শুর করেন। আর আধ মাইল দূর থেকেও সম্মিলিত 
আত'নাদের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। 

তাদের হাড় বের কর। নুয়ে পড়া মা! কিন্ত নিবিকার। ভাতের 
ফ্যান গালতে গালতে কোটরগত চোখ ছুটে দিয়ে অগ্নিবৃষ্টি করেন 
সমস্ত ব্যাঁপারটার ওপর | দীতে দাত ঘষে হিংত্র গলায় বলেন, 
মরুক-_মরুক__রাবণের গুষ্টি নিপাত যাক। শহরে এত প্লেগ হয়-_ 
এত কলেরার মড়ক লাগে-যম কি পৌড়া চোখে এই শুয়োরের 
পালকে দেখতে পায় না? 

এই বাড়ির দোতলাটা সংগ্রহ করেছিল ললিতা । আড়াইখান। 
ঘর-_অর্থাৎ ছুটে। ঘর, একটুখানি তিনদিক ঢাক বারান্দা-_সেখানে 
রান্নার কাজ চলে। ভাড়া পঁচাত্তর টাকা । দোতলার সি'ড়ির 
পুরোনো কাঠের রেলিংটা নড়বড় করে--একটু অসতর্ক হলেই 
বিপর্যয় কাণ্ড ঘটবার সম্ভাবন] । 

বাড়িতে ঢুকেই ললিঅ/নাকে কাপড় দিয়েছিল। পচা ইছুরের 
গন্ধ আসছিল কোথেকে। বিকৃত মুখে বলেছিল, ও মাগো-_এ 
কোথায় এলাম! 

আর শৈলেন দেখেছিল, একট! ছে'ড়া লুঙ্গি পরে বাজারের থলি 
হাতে এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোক সমানে ট্যাচাচ্ছেন ; একদিনে আধ 
পো। আলু শেষ করে বসলে? রাক্ষস ঢুকেছে নাকি তোমাদের' 
পেটে ? এই হারামজাদার পাল কি কাচা আলু খেয়েই সাফ করে 
দিয়েছে নাকি? 


৫ 


মনে মনে শৈলেন বলেছিল, কী সর্বনাশ ! 

তিন-চার দিন গুম্‌ হয়ে থেকে ললিতা বলেছিল, এ বাড়িতে 
কেমন করে থাকা যায় বল তো? 

যেমন করে নিচের ভদ্রলোক রয়েছেন । 

উনি পারলেও আমর পারব না। 

না পেরে উপায় কী? যাওয়ার জায়গা কোথায়--বলে। ? 
এ বাড়ি যোগাড় করতেই প্রায় এক বছর সময় লাগল- সেট! 
খেয়াল আছে? 

বাড়ির দরকার নেই। চলো-_আমর! গড়ের মাঠে গিয়ে তাবু 
খাটিয়ে থাকি ! 

কথাটা বেশ রোম্যার্টিক, শুনতে মন্দ লাগে না। কিন্ত 
গভনমেন্ট একটু বাধা দেবে । তা ছাড়! ওখানে এখন মিলিটারীর 
আড্ডা। এই টুকটুকে রাঙা বউ নিয়ে আমি-_ 

থাক, থাক, আর বলতে হবে না। 

সত্যি, বলে কোনো লাভ নেই । চেষ্টা-চরিত্র করলে বব্রং চাদে 
গিয়ে পৌছোনো৷ চলে, কিস্তু বাড়ি ভাড়। পাওয়া যায় না, ট্রেনে 
রিজার্ডেশনও নয়। সুতরাং এইখানেই থেকে যেতে হল। থেকে 
যেতে হল এই আঁড়াইখান! চুন-বাঁলি খসা ঘরের অবরুদ্ধ আব- 
হাওয়ার ভেতরে, নিচের দারিত্র্যজীর্ণ অপরিচ্ছন্ন জীবনের সঙ্গে 
মানিয়ে-_বীভৎসতম ল্লানের ঘরের বিভীষিকাঁকে সহ্য করতে করতে । 

বা়ি-বদলানোর কথা প্রায়ই উঠেছে। নিচের উঠোনে উকিল 
বাবুর ছেলেমেয়েদের আত্নাদ শুনতে শুনতে-বর্ধার দিনে ছাত 
থেকে চুন-বালি খসে পড়ার আতঙ্কের মধ্যে--যখন মনে হয়েছে £ 
এখনি বুঝি সবসুদ্ধ ধসে পড়বে মাথার ওপর। অথবা কখনে! 
কখনে। নিচের তলার ছেলেমেয়েরা এসে রেডিয়োর চাবি খুলে 
দিয়েছে, কিংবা! একরাশ কাপ-ডিশ ভেঙে ফেলেছে, তখন ললিতা 
বলেছে, না আর নয়। 

শৈলেন বলেছে, ঠিক কথা। অসম্ভব। 

৫৪ 


আর এখানে থাকা যায় না। 

থাকলে পাগল হয়ে যাব! 

একট বাড়ি দেখো । যেখানে হোক---যেমন হোক । 

আমাদের অফিসের তারাপদ খবর দিয়েছিল গড়পারের 
ওদিকে ছ্'ঁধান। ঘর খালি আছে | অফিস ছুটির পরে যাব সেখানে-_ 
অত্যন্ত দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ মনে হয়েছে শৈলেনকে । 

তাই করো। দরকার হলে টাকা আগাম দিয়ে এসো ।-- 
ললিতা আরও বেশি উৎসাহিত হয়েছে । 

কিন্ত অফিস থেকে বেরিয়েই হয়তো মত বদলেছে শৈলেনের । 
এই সারাদিন খাটুনির পরে এখন আবার গড়পারে দৌড়োনেো। 
আজ থাক। 

বাড়ি ফেরবার পরে চা দিতে দিতে ললিতা হয়তো! অলস 
কৌতুহলে জানতে চেয়েছে £ গিয়েছিলে গড়পারে ? 

যাব ভাবছিলাম । কিন্তু ভারী টায়ার্ড লাগল। যাব আর 
একদিন । 

আচ্ছা, যেয়ো আর-একদিন । 

ব্যাস্‌_-এই পর্যস্তই । এমনি করেই কেটেছে মাসের পর মাস-_ 
বছরের পর বছর। কখনে। তারাপদ, কখনো হরিপদ, কখনে! 
বামপদ-_-অথব1। অমনি যেকেউ খবর এনে দিয়েছে বাড়ির। ছু- 
একবার দেখাও হয়েছে-_কিস্ত পছন্দ হয়ে ওঠে নি। 

বড় বেশি ভাড। চায় কিন্ত । 

শৈলেন বলেছে, সেতো বটেই। দু'খানা ঘর আর একট! 
ব্বাম্মাঘর আশি টাকা! অসস্ভব। 

নইলে 

ভাড়াট1 কম বটে, কিন্ত ঘর ছুটে দেখছ! কী অন্ধকার। 

দিনের বেলাতেও আলে। জ্বালতে হয়। 

সেই এঁদে। বাড়িতেই যদি থাকতে হয়--তা হলে এ আর 
দোষ করেছে কী! 


৪ 


কিছু নাকিছু না। বদলাতে হলে ভালো! দেখেই বাড়ি 
খুঁজে নিতে হবে--বারে বারে ঠাইনাড়া করবার মেহনত কি 
পোষায়? বাড়ি বদল তে। নয়--যেন কুরুক্ষেত্র কাণ্ড! 

তা হলে বারণ করে দিই ? 

দাও। 

আর নতুবা £ 

বাড়ি তো মন্দ নয়-_ভাড়াও সস্তাই-__কিন্তু বাড়িওলা-_ 

লোক বাপু ভালে! বলে মনে হল না। কী ক্যাটর্কেটে কথা৷ । 
আবার বায়নাক! কী-_বাঙাল কিন1--ঝগড়াটে কিনা--বাড়িতে 
সময়-অসময়ে মানুষজন আসা যাওয়া করবে কিনা । অত দিয়ে 
তোমার কী দরকার--শুনি? ভাড়া দেব মাসের পয়লা তারিখে, 
থাকব নিজেদের মতো, তোমার সবতাঁতেই অত নাক গলানো কেন? 

তা ছাড়! সাত বছর মামলা করে তবে আগের ভাঁড়াটেকে 
তুলেছে। 

তবে তো সাংঘাতিক লোক। না বাপুঃ ও"সব ঝামেলায় 
আমাদের দরকার নেই। তুমি থাকো অফিস নিয়ে--আমাকে 
দৌড়োতে হয় স্কুলে! ও-সমস্ত মামলা-মোকদর্মার হাঙ্গীমা কে 
পোয়াবে। ছেড়ে দাও-_সুস্থ শরীরকে আর ব্যস্ত করতে 
হবে না। 

আসল কথা, এই পুরোনো এ'দেো৷ বাড়িটা যেন অভ্যাস 
হয়ে গেছে ছু'জনের। এ-যেন একটা বিশ্রী বিরক্তিকর নেশা-- 
খারাপ লাগে, অথচ ছাড়বারও শক্তি নেই। বাড়ি বদলের 
কথা ভাবলে মনট! প্রথম দিকে বেশ উৎসাহিত হয়ে ওঠে। 
কিন্ত একটু পরেই মনে হয়--থাঁক না, চলে তো! যাচ্ছে এক 
রকম করে । 

ছু' জনের ছোট সংসার- নিজেদের মতো করে থাকা । রোজগার 
যা হয় তাতে জীবিকার প্রয়োজন মিটিয়েও সামান্য কিছু উদ্বৃত্ত 
থাকে প্রায় প্রতি মাসেই। সেটা খরচ হয় পুজোর ছুটিতে 


৬৯ 


ভারতবর্ষের এক্্রাস্তে ওণ্রান্তে লম্বা পাড়ি জমিয়ে । মোটের 
ওপর আখশ্মতৃপ্ত আর আত্মকেন্দ্রিক জীবন যাত্রা । 

এই শামুকের খোলার মধ্যে বাস করে করে এখন আর 
চট করে নতুন কিছু করবার উৎসাহ আসে না। বাড়ি বদলেরও 
না। দেৌঁড়োদৌড়ি করো--দরদাম করো_একে ধরো, তাকে 
ধরেো। তার পরে কোথায় লরী- কোথায় কুলি। নতুন আস্তানায় 
গিয়ে আবার সব গুছিয়ে নেবার বিরক্তিকর ব্যাপার । সেনব 
মিটলে অন্যান্ত ভাড়াটেদের সঙ্গে নতুন করে মিতালি পাতানে!। 
সেট। সহজে সম্ভব হবে কিনা কে জানে-__হয়তো! এমন লোকের 
সঙ্গে বসবাস করতে হবে--যাঁদের সঙ্গে এক ঘণ্টা কাটানোও 
£সাধ্য। 

তাই আট বছর ধরে আর বাড়ি বদল করাই হয় না। 

দক্ষিণ কলকাতার বন্ধুরা এলে প্রীয়ই বলেন, এখানে কী 
করে থাকো হে। আমাদের যে ঢুকেই দমবন্ধ হয়ে যায়। 

শৈলেন জবাব দেয়, উত্তর কলকাতায় এর চাইতেও খারাপ 
গলি আর খারাপ বাড়ি আছে ভাই। মানুষ সেখানেও থাকে-_ 
এবং বেঁচেও থাকে। 

তা বটে-_তা বটে। বাড়িটা কেমন আনহেল্দি-__ 

ইমিউন্ড্‌ হয়ে গেছি। তোমাদের দক্ষিণই বরং আমাদের 
এখন সইবে না। অত মলয় পবন গায়ে লাগলে শেষ পর্যস্ত 
সর্দি বর হয়ে বসবে। 

তা যাই বলো, বাড়িটা বদলানো! দরকার | 

বেশ তো দাও না খুঁজে । 

্রঙ্ধান্ত্র। শৈলেন জানে, মুখে সছুপদেশ দেওয়া শক্ত নয়-_ 
কিন্তু উপযাচক হয়ে তাকে একটা বাড়ি খুঁজে দেবে এমন 
সদিচ্ছা বন্ধুদের কারে! নেই--অতখানি সময়ও না। 

ললিতার বান্ধবীর অবশ্ত টিপ্রনি কাটে অন্যদিক থেকে । 

খুব টাকা জমাচ্ছিস-_-কী বলিস ভাই? 


৬ 


মালে? 

মানে আবার কী? হু'জনে মিলে তে! কম রোজগার করিসনে । 
কিন্তু এই এ'দো বাড়িতে পড়ে থেকে--অল্প ভাড়া দিয়ে--বেশ' 
তৃ' পয়সা জমছে ব্যাঙ্ছে। 

যতটা! সস্তা ভাবছিস তা নয়। ইলেকটিকের বিল নিয়ে প্রায় 
একশো! টাকা পড়ে । 

জ্যা! 

বান্ধবীদের চোখ প্রায় কপালে উঠছে; একশো টাকা-_ 
বলিস কী! 

বিশ্বাস না করে1-_বাড়ি ভাড়ার রসিদ দেখাতে পারি । 

এত টাক? দিয়ে এখানে পড়ে আছিস কেন? চলে আয় না 
সাউথে-__নিদেন পার্ক সার্কাসে । বেশ. খোলা হাওয়া পাবি-- 
চারদিকে গ্রীন আছে--পার্ক আছে-- 

দে না! একটা খুজে । 

বান্ধবীরা একটু চুপ করে থাকে । শেষে একজন বলে, ইস ক'টা 
দিন আগে যদি বতিস! আমার মামাই তো একটা ফ্র্যার্ট 
ভাড়া দিলেন হিন্দুস্থান পার্কে। তেতালায় তিনটে ঘর-_মাত্র 
আড়াইশেো টাকা 

মাত্র আড়াইশো। ! ললিতা হাসে ঃশ দেড়েক টাকার সাহায্য 
তুই যদ্দি মাসে মাসে করিস তা হলে বরং ও রকম একট! ফ্ল্যাটের 
কথা ভেবে দেখতে পারি । 

যাঃ__ ঠাট্টা করছিস। ছু'জনে মিলে এত টাকা আনছিস-- 

পরের পীচটা টাঁকাও পীচশো টাকার মতো দেখায়-_এমনি 
একটা অপ্রীতিকর কথা! বলতে গিয়েও সামলে নিয়েছে ললিতা । 
বান্ধবীরা চা খেয়েছে- গল করেছে--ভার পর বেরিয়ে যাওয়ার সময় 
আর একবার মনে করিয়ে দিয়ে গেছে £ না ভাই, সত্যিই এবার একট। 
নতুন বাড়ি দ্যাখ। শৈলেনবাবুর তো! অনেক জানাশুনো আছে--- 
একটু চেষ্টা করলে উনি কি আর বাড়ি জোটাতে পারেন না? 


এত সব সত্বেও এ বাড়িতে অনেকগুলো দিন কফেটেছে। আট 
বছয়। নিচের তঙায় ওই পুলিস কোর্টের পসারহীন উকিলবাবুঃ 
তার কুদ্ধপা স্ত্রী--শিক্ষা সংস্কৃতিহীন ছেলেমেয়ে, প্যাচপেচে নোংরা 
উঠোন, বীভৎসতম কলধর--সব সয়ে যাচ্ছে একরকম। শীমুকের 
খোলার মতে। আত্মকেক্দ্রিক জীবন একরকম কেটে চলেছে । 

ত1 ছাড়া দমদমায় একটুকরে! ভালো জমির খবর পাওয়! গেছে-_ 
বেশ সম্ভাও বটে। ন্বামী স্ত্রী বছর খানেক থেকেই ভাবছে, 
জমিটুকু কিনে ওখানে একটা ছোটমতো! আস্তানা করে নিলে মন্দ 
হয় না। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড আর ইন্সিয়োরেন্দ থেকে ধার পাওয়া 
যাবে-ব্যাঙ্কেও হাজার ছুই টাকা! জমেছে । কল্পনাটা মনে আসবার 
সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি বদলানোর উৎসাহও নিবে এসেছে । আর বার 
বার ঠাইনাড়া হয়ে কী হবে-_-একেবারে নিজেদের স্থায়ী ভিটেতে 
গিয়ে ওঠাই ভালো! । 

কিন্ত এর মধ্যে একটা বোম! ফাটল। আর সঙ্গে সঙ্গেই 
মনে হল---যেমন করে হোক এবার বাড়ি বদলাতেই হচব---এখানে 
আর থাকা চলে না। 

এক মুহুর্তের জন্তেও না । 

ব্যাপারট! ঘটেছে রবিবার দ্রিন। 

এণবাড়ির যে ছোট ছাতটুকু আছে_-তা আইনত শৈলেনদের 
আওতায় । কিন্তু তাই বলে ছাতের একচ্ছত্র মালিকানা! কখনো 
দাবি করে নি শৈলেন। তাদের নিজেদের প্রয়োজন যৎসামান্য- 
ছু একখান। শাড়ি-কাপড় শুকোনো ছাড়া ছাতের সঙ্গে বিশেষ 
কোনে। সম্পর্কও নেই। একতলার গিশ্লীই ওখানে তার রাশি রাশি 
কাথা-কাপড় এনে জড়ো! করেন- তারই ছেলেপুলে ওখানে হুল্লোড় 
করে- ঘুড়ি ধরার চেষ্টা করে থাকে । 

চেঁচামেচি হয় না তা নয়। মাঝে মাঝে বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে 
এলেও ললিতা সহা করে গেছে। কিন্তু সেদিন একটা অঘটন 
ঘটে গেল। 


৪ 


হুপুরবেল! অমানুষিক চিৎকার আরম্ভ হল ছাতে। একটু ঘুম 
এসেছিল, সেটুকু তো! গেলই-_সঙ্গে সঙ্গে মাথা ধরে গেল। ললিতা 
আর থাকতে পারল না। 

এই--কেন অমন চেঁচামেচি জুড়েছিস ছুপুরবেলায় ? 

আমরা খেলছি । 

এ কিরকম খেলা? ভর দুপুরে একবারে ভূতের কীর্তন জুড়ে 
দিয়েছিস ? নাম-নেমে যা! লেখা নেই, পড়া নেই--সারাট। হুপুর 
হা মাস একেবারে ভাজা ভাজ করে দিলে । নেমে যা বঙ্গছি-_ 

কিন্ত বোমার পল্তেয় আগুন দিলে দশ-এগারো বছরের 
মেয়েটি । এ বয়েসেই যেমন মুখরা, তেমনি ছূর্দাস্ত। পটাং করে 
বলে ফেলল £ ই:-উনি বললেই নেমে যাব! বাড়ির মালিক 
কিনা উনি? আমরাও তো ভাড়া দিয়ে থাকি ! 

ললিতার ব্রঙ্গরন্ত্র জ্বলে গেল । 

তীব্রশ্বরে ললিতা বললে, খুব কথা শিখেছিস তে? ভাড়া 
দিয়ে থাকিস! ভাড়া দিস একতলার--দোতালায় যে তোদের 
উঠতে দ্রিই সে দয়া করে । নেমে যা বলছি এখুনি-__ নইলে চড়িয়ে, 
গাল ভেঙে দেব! 

ললিতার রুদ্রমৃতি দেখে ছেলেমেয়েগুলো পালালো । কিন্তু 
তার পরেই রঙ্গমঞ্চে নামলেন উকিলবাবুর স্ত্রী। 

ললিতাকে সোজাসুজি যে কিছু বললেন তা নয়। মেয়েটি 
নিশ্চয়ই তার মায়ের কাছে সমস্ত জিনিসটার একটু বিস্তৃত অলংকৃত, 
বিবরণ দিয়ে থাকবে--একেবারে ক্ষেপে গেলেন ভদ্রমহিলা । 

ছেলেমেয়েখলোকে তিনি ডাইনে-বীয়ে ঠ্যাঙাতে লাগলেন। 
সার। বাড়ি জুড়ে দানবিক কান্নার যে কোরাস শুরু হল, তা শুনে 
মরা মানুষেরও লাফিয়ে ওঠবার কথা । কিন্ত সেখানেই শেব নয়। 
শিশুপালের চিৎকার ছাপিয়ে ভদ্রমহিলার শব্দভেদী বাণ এসে 
ললজিতাকে জর্জরিত করতে লাগল । 

কেন যাস-কেন মরতে যাস ওখানে ? বড়লোকের লাখি 


৬৫. 


বাটা না খেলে বুঝি পেট ভরে না? আর যদি কোনোদিন 
ছাতের দিকে এগোবি তা হলে জাঁশবটি দিয়ে ফেটে গঙ্গার 
ভাসিয়ে দেব সব কণ্টাকে। ৩:--ভারী বড়লোক হয়েছেন । 
টাকার গরমে ধরাকে সরা দেখছেন একেবারে । ছেলেপুলে 
একটুখানি খেল! করেছে বলেই সোনার অঙ্গ ক্ষয়ে গেল! আর 
সইবেই বাকী করে? নিজে তো বীজা-_একটাও পেটে ধরে নি 
- ছেলেপুলের মায়া বুঝবে কোথেকে ? 

এতক্ষণ সইছিল, শেষ কথাটায় একেবারে নীল হয়ে গেল 
ললিতা । 

দশ বছর বিয়ে হয়েছে__কিস্তু এখনো মা হওয়ার সৌভাগ্য 
ঘটে নি ললিতার। দিনের পর দিন নিঃসন্তান! মায়ের যন্ত্রণা তাকে 
তিলে তিলে পুড়িয়েছে-_মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে নি-__-খালি 
বুকের ভেতরটা তার জ্বলে জ্বলে খাক হয়ে গেছে। অনেকদিন 
বলাতে তার চাপা কান্নার শব্দে জেগে উঠেছে শৈলেন £ কী 
হয়েছে ললিত] ?--ললিত1 জবাব দেয় নি-_শৈলেনের বুকের মধ্যে 
মাথ!। রেখে ফু'পিয়েছে অনেকক্ষণ পর্যন্ত | 

ডাক্তার পরীক্ষা করেছিলেন । 

মাথা নেড়ে বলেছেন, আই আযাম সরি মিস্টার দে। মিসেস 
দে কখনে। মা হতে পারবেন না। প্রকৃতি ওকে বঞ্চিত করেছে। 
'ইয়োরোপে নিয়ে গিয়ে একটা অপারেশন করিয়ে দেখতে পারেন 
- কিন্তু তাতেও যে কিছু হবে তা জোর করে বলা যায় ন1। 

মিটে গেছে ওখানেই । ললিতা জীবনে কখনো মা হতে 
পারবে না। 

যন্ত্রণা । বুকের ভিতরে অন্তঃশীলা! যন্ত্রণা । আজকে নেই 
হন্ত্রণার ওপরে বিষ ঢেলে দিলেন উকিলবাবুর স্ত্রী। শৈলেন 
ইছাপুরে গিয়েছিল এক পরিচিত বন্ধুর পুকুরে মাছ ধরতে। 
সন্ধ্যাবেলায় যখন ফিরল, তখন ঘরে আলো জলে নি। মেঝেতে 
জাচল বিছিয়ে চুপ করে শুয়ে আছে ললিতা! 


৬ 


জতা ! 

জবাব নেই ! 

সীমাহীন আতঙ্কে শৈলেন ললিতার গায়ে হাত রাখল। ন! 
-সম্বাভাবিক নিশ্বাস পড়ছে, গায়েও কোনে! উত্তাপ নেই। শুধু 
মেঝের অনেকখানি ভিজে গেছে, আর থেকে থেকে সার? শরীর 
ফুলে ফুলে উঠছে তার। 

লতা কী হল! 

অবরুদ্ধ গলায় ললিত1 বললে, কালই এ বাড়ি ছাঁড়ো-_নইলে 
আমি সুইসাইড করব। 

বাড়ি অবশ্টা পরদিনই যোগাড় হয় নি। অফিসে গিয়ে ছু- 
একজনকে বলতে একজন বিচক্ষণ দালালের ঠিকানা পাওয়া! গেছে। 
আর সেই দালাল ভদ্রলোক তিন চারদিনের মধ্যেই এই বাড়ির 
সন্ধান এনে দিয়েছেন। তার দাবি বেশি নয়- শুধু একমাসের 
ভাড়াটা তাঁকে কমিশন দিতে হবে । 

বাড়ি দেখে শৈলেন মুগ্ধ । 

বাঃ_-একেই বলে বাড়ি। তেতলায় তিনখানি,ঘর--একেবারে 
নতুন। তিনদিকে রাস্তা। খোল! জানাল! দিয়ে হুছু করে হাওয়! 
আসছে। বড় রাস্তার কাছেই-_-অথচ বাস-উ্রামের ঘড়ঘড়ানিতে 
কান ঝালাপালা হয়ে যায় না। রাস্তা পেরলেই মার্কেট--পাচ 
মিনিটেই বাজার করে আসা যায়। 

দালাল বললেন, এ বাড়ির জন্তে কত লোক যে আসা-যাওয়া 
করছে তার ঠিক নেই। তবে আপনাদেরই ওদের পছন্দ । 
নিঝর্চাট সংসার আপনাদের-_ওরাও চান-_ 

অত্যন্ত উল্লসিত হয়ে ফিরেছে শৈলেন। 

হ্যাঁ-এতদিনে একট! বাড়ি দেখলাম বটে লতা । দেখে মনে হল 
--সত্যি, এ আমরা কোথায় পড়ে আছি! একি ভদ্রলোকের থাকবার 
জায়গা । আর ওখানে নতুন ঘর--চারদিকে বকবক করছে আলো-_ 
গ্রীষ্মকালেও পাখ। খুলতে হবে না এমনি প্রাণজুড়োনে! হাওয়া । 


৬৭ 


তবে বাঁড়িউলি ! 

না--ভদ্রমহিলা শিক্ষিত । খুব চমতকার ব্যবহার । 

বাড়িতে বড় বড় মেয়ে-_ 

স্ত্রী ষাত্রেরই এ একটা সংশয়ের জায়গা! । শৈলেন আশ্বাণ দিয়ে 
বলেছে £ ওদের আর-একটা আলাদ সিঁড়ি আছে। 

ললিতা চুপ করে থেকে বলেছে : আচ্ছা যা হয় ঠিক করো । 

আজকালের মধ্যেই আগামটা দিয়ে আঁসতে হরে কিন্তু । নইলে 
ওর! অন্ত কারুর সঙ্গে ঠিক করে ফেলবেন- অনেকেই বাড়িটার 
জন্যে ঘোরাঘুরি করছে। টাকাট। দিয়েই আসব তবে । 

বেশ তোে।। 

ললিতা চুপ করে বসে ছিল। এই বন্ধ বাড়িতে জানাল! দিয়ে 
যতটুকু আকাশ দেখা যায় তার দিকে তাকিয়ে। 

এখান থেকে চলে যেতে হবে । আট বছরের মায়া কাটাতে, 
হবে। মনটা খচখচ করছে। 

কিস্ত কিসের মায়া--কিসেরই বা বন্ধন? কী সম্পর্ক এই 
বাড়ির সঙ্গে? এও তো ভাড়াটে বাড়ি। একে মানুষের বাসের 
অযোগ্য তার ওপরে গলাকাটা ভাড়া । কোন ছুঃখে এখানে পড়ে 
থাকা_কিসের আকর্ষণে ? 

সব চেয়ে বড় কথা নিচের উক্িলবাবুর স্ত্রী। কী অশ্লীল-_কী 
কুংসিত--কী অশিক্ষিত ! বিন্দুমাত্র শিক্ষাদীক্ষা। থাকজে এমন 
কদর্য ভাষায় তাকে কি এভাবে কটু আক্রমণ করতে পারত ? 

কখনে। কখনে! উপকার একেবারে যে করে নি তা৷ নয়। একবার 
জ্বরে পড়েছিল--মহিলা এসে সেবা-শুজীষা করেছেন। বাড়ির 
চাকর পালিয়ে গেলে নিজের পনেরো! বছরের ছেলেটাকে দিয়ে 
বাজারও করিয়ে দিয়েছেন । মধ্যে মধ্যে পানের বাটা হাতে নিয়ে 
উঠে এসেছেন ওপরে, গল্প করেছেন বসে বসে, বলেছেন, দিদি 
আপনাদেরই জীবন সার্থক । কত লেখাপড়া শিখেছেন--কত জানেন ! 
আমাদের কেবল জোয়াল টেনেই গেল। 


৮ 


কিন্ত গুগুলো ! কেবল বাইরের মুখোৌন মাত্র। একটুখানি 
হাওয়াতেই সে মুখোস উড়ে গেছে--বেরিয়ে এসেছে বীভৎস কদর্য 
কূপটা। এতদিনে ললিতা বুঝেছে--কী ভয়ানক নরকের মধ্যে. 
তাকে বাস করতে হচ্ছিল। 

না--এ বাড়ি ছাড়তেই হবে। এখানে আর বাস কর 
চিলে না। 

সামনের বাড়ির জানাল! খুলল। মুখ বের করলে একটি 
'তরুণী বধূ । 

শুনলাম, আপনারা নাকি পাড়া ছেড়ে যাচ্ছেন ভাই ? 

খবরট1 ছড়িয়েছে এর মধ্যেই। দালালের আসা-যাওয়া 
দেখেছে সবাই--শুনেছে গলিতে দাড়িয়ে শৈলেনের সঙ্গে আলোচন]। 
কথাটা কারোই বোধহয় জানতে আর বাকী নেই এখন । 

চেষ্টা করছি তো।। 

বাড়ি ঠিক করলেন কোথায় ? 


এন্টালীতে। 
তা ভালোই। বাজারের এপারে না ওপারে ? 
ওপারেই শুনেছি । 


তা হলে মন্দ নয়। বাজারের এদিকটা নোংর1--ওধারট। 
'বেশ ঝকঝকে । আমার মামাও ওদিকেই থাকেন কিনা । কোন্‌ 
রাস্তায় ভাই? 

উনি জানেন । আমার মনে নেই। 

বধুটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল । 

তা যান। স্থবিধে মতো বাড়ি পেলে এখানে আর পড়ে 
থাকবেন কেন? তা ছাড়া নেহাত আপনারা বলেই এত ভাড়া 
দিয়ে এতদিন পড়ে ছিলেন এখানে--আর কেউ হলে রেন্ট কণ্টেলে 
নালিশ করে মজা টের পাইয়ে দিতেন বাঁড়িওলাকে। যাচ্ছেন 
ষান-পাড়াটা একেবারে কাকা হয়ে যাবে। 

শুধু পাড়াই ফাঁক। হয়ে যাবে না-_-ললিতার মনটাও ফাকা 


৬৯ 


হয়ে স্কেতে চাইছে এর মধ্যেই । এই পুরোনো এদো বাড়ি 
অসম্ভব রকমের বেশি যার ভাড়া--সেখানে খাকবার সপক্ষে 
কোনে! যুক্তিই কোথাও নেই। তবু যেন কোথায় নাড়ীতে টান 
পড়ছে--কী যেন একটা মায়ার বাধন জড়িয়ে ধরছে চারদিকে । 

জান্লাটা বন্ধ করে চলে যেতে যেতে ও-বাড়ির বধুটি বললে, 
সত্যি--ভারী খারাপ লাগছে । কবে যাবেন ? 

আসছে মাসেই। 

আমাদের ভূজ্মে যাবেন না? 

আমি ভুলব কেন? বরং আপনারাই ভূলে যাবেন। যারা দূরে 
চলে যায়-_তাদের কি কেউ আর মনে রাখে? 

ছি ছি, বলবেন না ওকথা । 

বৌটি চলে গেল । 

ঘরে চলে এল ললিতা । বাড়ি বদলাতে হবে। কিন্তু 
ঝামেলা কি সত্যিই কম! শৈলেন অবশ্য বলেছে, এমন কি 
আর জিনিসপত্র আমাদের আছে যে সেগুলো সরাতে তিন দিন 
লাগবে! তিন দিন লাগবার মতো! কিছু হয়তো নেই--কিস্ত 
যা জড়ো হয়েছে--তার পরিমাণই কি কম! খাট, চারটে চেয়ার, 
ড্রেমিং টেব্‌ল, ছটো আল্মারী, সেলাইয়ের কল, একটা ছোট 
সিন্দুক, রেডিয়ো, শ' দেড়েক বই, গোটা পাঁচ-সাত ট্রাঙ্গ-স্যুটকেশ, 
বাসনপত্র। এগুলোকে সরানো গলি থেকে সাবধানে বের করা, 
নতুন বাড়ির তেতলায় নিয়ে ওঠানো । তাতে যে কী থাকবে, কী 
ভাঙবে জোর করে বলা শক্ত। তার পরে সেগুলোকে আবার 
সাজানো-গোছানো ! ঝামেল। কি চারটিখানি! উঃ--ভাবতেই 
যেন গায়ে জ্বর আসতে চায়। আট বছর আত্মতৃপ্ত জীবন কাটিয়ে 
এখন আর এসব বিড়ম্বন। বরদাস্ত হয় না। 

কিন্তু যেতেই হবে। এখানে আর থাকা চলে না। 

ললিত একটা মৃছ নিঃশ্বাস ফেলল। সা্যাংসেতে দেওয়াল । 
মাথার ওপরে কড়ি-বরগার় পাশ থেকে মাঝে মাঝে বালি চুন 
পও 


খসে গিয়ে লাল ম্ুরকি বীভৎস হাসির মতো থেরিয়ে রয়েছে । 
এক-আধদিন মুষলধারে বৃষ্টি নামলে ছ'চার কেঁটা৷ জল ঢুইয়েও 
পড়ে ছাদ দিয়ে--ভয় হয়, কখন সব কিছু ধসে পড়বে। তবু 
-তবু এই ঘরটা বড় বেশি চেনা হয়ে গেছে--এর প্রত্যেকটি 
ইঞ্চির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে একটা অদ্ভুত অভ্যাস-_একট। নিবিড় 
মমতা ।-- 

তবু এসব কাটাতেই হবে। নিচের ভদ্রমহিলার সঙ্গে আর 
বাস করা চলে না। ওর মুখের দিকে ললিত এর পরে আর চোখ 
তুলেও চাইতে পারবে না৷ কোনোদিন । 

দিদি! ৃ 

বিছ্যৎংচমকের মতো! ললিত! চমকে উঠল । 

দিদি! 

ললিতা স্তব্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। উকিলবাবুর স্ত্রী এসে 
ঘরে ঢুকেছেন। 

কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই একট! নাটকীয় ঘটন। 
ঘটে গেল যেন। ভদ্রমহিল! প্রায় ছুটে এসে ললিতার পা! জড়িয়ে 
ধরলেন। তার সার। মুখ চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে । 

ছিঃ--ছি;-_এ কী করছেন ! 

আমায় ক্ষমা! করুন দিদি । আপনার মনে কষ্ট দিয়েছি--য। 
নয় তাই বলেছি, সেজন্তেই বুঝি ভগবান আমায় শাস্তি দিচ্ছেন ! 
কাল থেকে আমার মেয়েট! জ্বরে বেহু'স হয়ে রয়েছে-_একফৌটা 
জল পর্যন্ত গলছে ন! গল! দিয়ে । আমায় ক্ষমা করুন আপনার 
শাপেই-_ 

কী বলছেন আপনি? শাপ দেব কেন? ছিঃ উঠুন, উঠুন-- 

না, বলুন আমায় মাপ করেছেন_ আমার মেয়েকে আশীর্বাদ 
করেছেন। নইলে এখানে আপনার পায়ে আমি মাথা খুঁড়ে 
মরব! 

ভদ্রমহিলা! সত্যিই মাথ! খু'ড়তে লাগলেন মেজেতে । 


ণ৯ 


॥ 

ছু' হাত বাড়িয়ে ললিতা তাকে টেনে তুলল। সাব্বন! ফিয়ে 
বললে, একটু শাস্ত হোন দিদি। কেন মিথ্যে ছুশ্চিস্তা করছেন ? 
-হেলেপুলের অমন অন্ুখ করেই, আবার হ' দিন বাদে সেরেও যায়। 
চঙ্গুন, আমি দেখছি-_ 

ঠিক সেই সময়ে দোর গোড়ায় এসে গাড়ালো শৈলেন।' 

লগ্ক? বাড়ি ভাড়ার আগাম টাকাটা-_- 

বলতে গিয়েই থেমে গেল শৈলেন-_এক মুহুর্তে ঘরের দৃশ্যটা 
দেখতে পেয়েছে সে, একটা নতুন তাৎপর্য ধরা পড়েছে তার 
কাছে। যে ফাটলটা তৈরি হয়েছিল-_সেটা নিঃশেষে জুড়ে 
গেছে আপাতত । 

একস পরে আর ললিতার কাছে নতুন বাড়ির জন্যে টাকা চাওয়া 
যায় ন। তোধ হয় চাইতেও হবে না আপাতত । 

আস্তে আস্তে দরজার পাশ থেকে সরে গেল শৈলেন। যেন 
ওরা তাকে দেখতে না পায়। এই হুূর্বল মুহুর্তে ওদের ছ'জনকে 
সে আর লজ্জা দিতে চায় না। | 


প্‌ 


খ্লেনা 
' শেষ পর্যস্ত খু'জতে খুঁজতে বেগু ঘে এই দোকানে এসেও পৌঁছবে 
মীরা এতখানি 'মাশা করতে পারে নি। প্রগ্ল্ভ সন্ধ্যা ধারালো! হয়ে 
আছে চারদিকে । একটু দূরেই মত্ত সিনেমা-হাউসটার আমনে বাশি 
রাশি মোটরের প্রতীক্ষা । বিরাট রতীন পোস্টারে স্প্যানিশ 
কারমেনের উন্মত্ত নাচের ভঙ্গি। সামনের হোটেলের গায়ে নীলাভ 
নিয়নের নিলজ্জ আত্মঘোষণা £ লেটুস গে টু 
হাওয়াই শার্ট, লেলর শার্ট, নান! রকমের ট্রাউজার, কষ্িনেশন 
শু। সালোয়ার, ভয়েলের শাড়ি, প্যারীর সন্ধ্যার সুগন্ধি। হয়াঙ্কী 
সিগারেটের চকোলেট ফ্লেভার । দু'জন বিদেশী নাবিকের সঙ্গে রাস্তার 
ওপরেই ভাব জমাতে চাইছে সস্তা! রেয়নের স্কা্ট-পরা শীরদেহ একটি 
আযাংলো-ইগ্ডিয়ান মেয়ে। ময়র! শিয়ারারের নাচের অর্কেন্্রীর ঘুরি 
ঘুরছে হাওয়ায় । 
এইখানে বেণু! শুধু বেমানান নয়-_দস্তরমতো অবাঞ্ছিত। 
প্রথমটায় অত লক্ষ্য করে নি মীরা । কাউন্টারের টেবিলে 
ঝুঁকে পড়ে ক্যাশমেমো৷ কাটছিল একজন পার্শা ভদ্রলোকের জন্তে । 
আবছা চোখ তুলে অভ্যাসের হাসি ফুটিয়েছিল ঠোটের কোনায়, 
মিষ্টি গলায় বলেছিল, ওয়ান মিনিট ল্লীজ। 
বেয়ার প্যাকিংগুলো৷ বাইরের গাড়িতে তুলে দিয়ে আসবার 
পরে, চোখ তুলে তাকাবার ফুরন্থৃত পেল মীরা ; ওয়েল ম্যাডাম, 
হোয়াট ক্যান্‌ আই ডু কর্‌ ইউ? 
কিন্তু ম্যাডাম নয়-_বেণু! একপাশে ভূপাকার রকিং হস: 
থলে দেখছিল এক মনে । এইবার ফিরে দাড়ালো । 
আরে, তুই? 
খাঁটি অন্তরক্ষ বাংলায় মীরার বিস্ময় চল্‌কে পড়ল । 
বাস্তবিক | বেণুকে ম্যাডাম বলবার মতো! কোনে কারণ কোথাঁও 


দি 


মেই। আঁচল জড়িয়ে পর সাধারণ ডুরে শাড়ি--পায়ে শক্ত 
চামড়ার বিবর্ণ কাবলী চটি। গায়ে ময়লা ছিটের ব্লাউজ, কাধের 
ঝোলটিধ আয়ছনে প্রায় বেণুরই সমান। না, ও ভাষায় ওকে 
অভ্যর্থনা! কর] যাঁয় না। 

খ্বান্থ্যে উজ্জ্বল ঝকঝকে হাসি হাসল বেণু £ অনেকদিন পরে 
তোর খবর নিতে এলাম । 

অনেকদিন--সন্দেহ কী। কলেজ ছাড়বার পরে সেই চার বছর 
আগে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল রাস্তায়। ফেমন আছিস্‌, কোথায় 
আছিস্--শুর করতে না করতেই টুক করে সামনের ব্রীমটায় উঠে 
পড়েছিল বেগু। বলেছিল, আজকে সময় নেই ভাই, অফিস আছে ॥ 
আর-একদিন কথ। হবে। 

আজ সেই আর একদিন। ছু* বছর পরে? আড়াই বছর ? 

প্রায় নিরর্থক সঙ্কোচেই শাড়ির আচলটাকে ভালো করে 
গুছিয়ে নিলে মীরা । বললে, বোস--বোস। 

কিন্ত অনুরোধ করবার দরকার ছিল না-_অন্তত বেণুকে 
তো নয়ই। ঘড়ঘড় করে একটা লোহার চেয়ারকে টেনে এনে 
ধপ করে বনে পড়ল। বেয়ারাটা পর্বস্ত চমকে উঠল এমনি 
অসঙ্গত ব্যবহারে ৷ 

বেগু বললে, বেশ জায়গায় চাকরি নিয়েছিস। খেলনার 
দোকানে । 

চাকরি সব জায়গাঁতেই সমান-_মীরা সপ্রতিভ হতে চেষ্টা 
করল £ খেলনার দোকানেই ছোক আর জাহাজ কোম্পানির 
অফিসেই হোক। 

বেণু প্রতিবাদ করল না ঃ তা বটে। তবু আবহাওয়ার খানিকটা 
তফাত আছে তো।। গাদ! গাদা ফাইলের চাইতে রং-বেরঙের খেলন? 
ঢের ভালো--চোখ ছুটে জুড়িয়ে যায় অস্তত। 

জুড়িয়ে যায় নাঁ_জালা করে। কখনো কখনো পাগলের 
মতো ভাঙচুর করতে ইচ্ছে হয় সমস্ত। সেলুলয়েড আর প্লাস্‌ 


দ্‌$ 


টিকের পুডুলগুলোকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছে হয়--. 
ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয় মেকানিক সেট্গুলোকে--.ম্যাজিক কারের 
বইগুলোকে কুচি কুচি করে ছি'ড়ে ফেলার আকাজ্জা জাগে, 
আর অদ্ভুত কল্পনায় মনে হয় পাশাপাশি সাজানো ওই “কর্ক- 
গানগুলো যদি “শট গান? হতত-- 

কিন্তু সে ক্লান্তি, সে অবসাদের কথা! বলা যাবে না বেণুকে। 
বড় বেশি শ্বাচ্ছ্যের হাসি বেণুর পরিষ্কার দীতগুলোতে, বড় বেশি 
ভালে-লাগার আনন্দ ওর ছু চোখে ঝলমল করছে। আপাতত 
ওর সেই ভালো-লাগ! খানিকটা! ধার করে নিতে হবে মীরাকে 
কিছুক্ষণের জচ্যেও । 

কথাগুলোকে তত্বের দিক থেকে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে ঘুরিয়ে আনতে 
চাইল মীর] । 


তুই এখনো! সেইখানেই চাকরি করছিস বোধ হয় ? 

কোথায়? সেই রিহ্যাবিলিটেশনে ? নানা, সে অনেক- 
দিন গেছে। 

ছেড়ে দিয়েছিস ? 


এ বাজারে ইচ্ছে করে কেউ চাকরি ছাড়ে ?_বেণুর হাসিটা 
এবার একটু ফিকে মনে হলঃ তা ছাড়া অমন ভালো মাইনের ? 
ছাড়িয়ে দিয়েছে। 

কেন ?-_প্রশ্নটা করেই মীরার মনে হল জিজ্ঞাসা করার কোনো 
দরকার ছিল না। চাকরি কেন যায় এ নিয়ে চিন্তা করবার 
অর্থই নেই আজকাল 7; কেন থাকে মেইটেই গবেষণা করবার মতো । 
এই চার বছরে মীরাঁকেও তিনবার চাকরি বদলাতে হয়েছে। 

বেণু অবশ্য উত্তর দিলে একটা । 

ওভারস্টাফড্‌। আর--আর রাজনীতি । 

শেষ শব্টায় মীরা একবার চমকে উঠল। বেণু কি আজও 
কলেজের অভ্যাস ছাড়তে পারে নি, আজও কি রাঞজনীতি করে ? 
সামনের দেওয়ালে নগ্ন নিলজ্জ নিয়নটার ঝাঁব যেন মীরার চোখে 


৭% 


এসে জাল, কুঁচকে এল চোখের পাতা । মনে পড়ল, এই দোকানের 
মালিক “মিল্টার পালিয়! ফলাজনীতির কাকড়া-বিছের ভয়ে সন্ত 
আছেন দিব সময়ে । 

ও1--একটা নিরুত্তাপ একাক্ষর উচ্চারণ কর মীক্বা। 
ভয়েলের অবাধ্য শাড়িটা আবার পিছনে পড়তে চাইল কাঁধ 
থেকে । একবার বলতে ইচ্ছে হল £ তুই আঙ্গ আয় বেণু--বড় ব্যস্ত 
আছি এখন ।-_কিস্ত বলবার আগেই নতুন খরিদ্বারের ভারী জুতোর 
আওয়াজ এল দোরগোঁড়ীয়। একটা কণড়। কেটে গেল যেন। 

ওয়েল স্যার__হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? 

সেই স্বর-_সেই স্ুর। যে গলায় বেণুকে সম্ভাষণ করেছিল, 
অবিকল দেই রকম। আশ্চর্য আয়ত্ত করেছে মীরা-বার বার 
একই প্রয়োজনে গ্রামোফোন রেকর্ড বাজানোর মতো নিভু 
পুনরাবৃত্তি! শুধু স্যর আর ম্যাডামের তফাতটুকু ছাড়া আর 
কিছুই নেই। 

বেণুর কাছ থেকে ছু-হাত দূরে ফাউণ্টারের ওপরে ঝুকে 
পড়েছে লোকটা । মাঝবয়েপী লোক- মাথার অধেকিটা জুড়ে 
চকচকে টাক। তবু ভাজ করা ঘাড়টা সযত্বে ছ'টা-__পাঁউ- 
ডারের পুরু প্রলেপ সেখানে । শার্টের কলারের নিচে একটা 
লাল রুমাল জড়ানো । পাউডার, ঘাম__আর, আর স্পিরিটের 
মতো! কিসের একটা গন্ধ পাখার হাঁওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময় । 
মদ খেয়ে এসেছে লোকটা! । 

একবার তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল বেণু-চোখ মেলে 
বাখল সামনের একটা শেল্ফের দিকে । পর পর হুটো তাকে 
একদল রবারের খেলনা-_মিকি-মাউস্-_ভোনাজ্ড ডাক। অদ্ভুত 
সুখভঙ্গি করে তাকিয়ে আছে তারা-_ভ্যাংচাচ্ছে যেন । 

ক্াস্তায় ব্যাঞ্জোর সুর--সেই লম্বা রোগ! অন্ধ লোকট] চলেছে। 
ছুটি লাল টকটকে খাস বিলিতী সাহেবের পেছনে চলেছে কালো 
কালে। ভিখারী ছেলের পাল। একট! লোক বিক্রি করতে চাইছে 


খপ 


বেলফুলের মলি। চৌরঙ্গীতে বেলফুল! বেখুর মতোকি অস্বাভাবিক 
মনে হচ্ছে। 

বাইরের নাচের রেকর্ডের মতোই মীরার গলাও বেজে চলেছে 
একটানা । টুকরো! টুকরো! শ্রুনতে পাচ্ছে বেণু। 

মেকানিক্‌ সেট--ছেলেদের ইন্টে লিজেন্স, বাড়ে 

নোনো--ও নয়-_মদ-খাওয়া গলার ভরাটি আওয়াজ । ঠিক 
ব্লাড হাউগ্ডের আওয়াজের মতো! £ নতুন কিছু চাই--বন্ধুর ছেলের 
জন্মদিন -- 

এই ক্যাট আযাগড দি বল দেখুন। স্প্রাড দিলেই বল 
নিয়ে ডিগবাজী খেয়ে খেলা করবে বেড়াল। খাঁটি জাপানী ডল । 
কাস্টম্স বাচিয়ে আনা । কলকাতায় শুধু আমাদের দোকানেই 
পাওয়া যায়। ভেরি চীপ- মাত্র কুড়ি টাকা_ 

খুব .সম্তা__মাত্র কুড়ি টাকা বেণু ঢোক গিলল। একটা হ- 
পয়সার খেলার পুতুল ক'জনে আজ কিনে দিতে পারে বাচ্চাদের ? 
কিন্ত শেয়ালদার রথের মেলার কলকাতা এ নয়। এ আলাদ!। 
সামনে জ্বলস্ত নিয়ন £ লেটস গো! টু! এক রাত্রে কত খরচ 
হয় ওগুলো! জ্বালতে ? রাস্তায় এখনে! বেলফুল বেচছে লোকটা । 
বৃষ্টি থেমে যাওয়। শাস্ত অন্ধকারে, নারকেল পাতা থেকে টুপ, 
টুপ করে টিনের চালায় জল পড়বার শব্দের সঙ্গে একাকার 
হয়ে যায় ভিজে মাটি আর বেলফুলের গন্ধ । সেই বেলফুলের 
কত দাম এখানে ? পাঁচ টাকা? দশ টাকা? কেজানে! 

অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল__চমক লাগল হঠাৎ। তীক্ষ-তীত্র 
ভঙ্গিতে হাসছে মীরা--প্রতিদিনের অভ্যাসে অভ্যাসে শানানো 
হাদি। মদ-খাওয়া মোটা গলায় তখনো জড়িয়ে জড়িয়ে "2: 
জের টানছে লোকট।। কিন্তু একবার তাকিয়েই আবার মিকি- 
মাউস্গলোর দিকে চোখ ফিরিয়ে নিতে হল বেণুকে। হ'চোখে 
লোকটার আদিম ক্ষুধার নগ্ন অন্ুসন্ধিতসা-_মীরার় গা থেকে 
কখন পিছলে পড়ে গেছে পাতলা ভয়েলের শাড়িটা । 


বিঝিমাউসের বিকসিত হাদগিতে যেন মর্ণান্থিক কোৌদুক। 
মীরার ঈ্রন্যে কোমল সহানুভূভিতে ভরে উঠল বেণুর মন। 
চাঁকরিই টে ! কী ভয়ঙ্কর মূল্য দিতে হয় তার জন্তে । 

নোটের খচখচ. আওয়াজ-_ক্যাশমেমো লেখার শব্দ- কয়েকটা 
চেঞ্জের ধনৎকার । আবার এক টুকরে! জড়ানে! রদসিকতা--শান 
ঘেওয়! হাসির একটা তীক্ষ ঝিলিক, মিষ্টি সুরে থ্যাক্ক ইউ 
তার পর্ন একটা প্যাকেট বগলে করে আবার বেণুর পাশ দিয়ে 
খচমচিয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা । ফ্যানের হাওয়ায় আর-একবার 
পাক খেলো ঘাম, পাউডার আর স্পিরিটের সেই মিশ্র গন্ধটা । 

বেণু!__স্তিমিত শীর্ণ ডাক শোন! গেল মীরার । 

বেণু মুখ ফেরালো £ বল? 

এইবার তোর খবর শুনি। কী করছিস? 

একটা আশ্রম করেছি রিফিউজী মেয়েদের নিয়ে ।--বেণু 
সহজ হতে চাইল £ কাজ কিছু তো! নিয়ে থাকতে হবে। তা 
ছাড়া নিজের সংসারও রয়েছে 

থাম্‌--থাম্-ভূত দেখার মতো! চমকে উঠল মীরা! £ নিজের 
সংসার ?1 বিয়ে করেছিস? 

হা, করলাম একটা বেণুর শ্যামবর্ণ স্থাস্থ্যন্সিগ্ধ মুখে ভারী 
উজ্জ্বল দেখাল হাসিটা। 

কাকে রে 1-_-অদ্ভুত উত্তেজনায় সারসের মতো গলাটা বাড়িয়ে 
দিল মীরা--চোখের ওপক় সেলোক্ষোন কাগজের মতো৷ কী চকচক 
করে উঠল: কেসে? 

চাঞ্চল্যকর কেউ নয় ভাই। নিতান্তই পাড়ার্গায়ের স্কুল 
মান্টার |_-বেণুর যুখে হাসিটা তেমনি জলঙজ্বল করতে লাগল £ 
তার ওপর ছু'বার জেল ফেরত। 

তবু সাস্বনা পাচ্ছে না মীরা-কেমন তেতো লাগছে গলার 
ছেতর। প্রীয় নিঃশ্বাস বন্ধ করে, যৃত্যুদণ্ড শোনবার মতো ছাপা 
তরে জানতে চাইল $ আর--আর বাচ্চা? 


১৪ 


আছে একটা ছেলে বছর ছয়েকের। ভারী হুরস্ত--বেখুর 
স্টামবর্ণ মুখে লঙ্জার ঢেউ ছুলে গেল, ভারী মেয়েলী রাগল একদা 
স্পেটিস্স্যান ৰেণুকে। 

টেবিল থেকে টুপ করে একটা পেনসিল পড়ে গ্বেল নিচে। 
সেটাকে খুঁজতে কাউন্টারের ওপারে ডুবে গেল মীরা--আবার 
বেণুর মুখোমুখি উঠে দাড়াতে প্রায় মিনিট ছুই সময় লাগল। 

বেশ আছিস তা হলে! একেবারে গিন্নী! ভারী খুশি 
হলাম- কাউন্টার থেকে সরে গেল মীরা, একটা বল নিয়ে এন্গ 
তাক থেকে £ এইটে নিয়ে যা--তোর বাচ্চাকে দিস। 

থাক । 

থাকবে কেন? _রং-করা ভজ্রতে অভিমানের রেখা! বাঁকিয়ে 
ভুলল মীরা £ আমি দিচ্ছি তোর খোকাকে। 

সে হয় না ভাই--কিছু মনে করিমনে--একটা বিষণ নিশ্বাস 
ফেলল বেণু। 

মাসী হিসেবে এটুকু দেবার জোর অন্তত আমার আছে, 
মীরা বলতে চাইল। হয়তে। এরকম বলতে হয় বলেই ক্ষোভের 
রেশ টানল গলায় । 

তুই ভূল বুঝছিস আমাকে--বেণুর স্বরে আবেগের ছোঁয়া 
লাগল £ শুধু আমার বাচ্চা তো নয়--আরও পনেরো-বিশটি 
আছে ওখানে । নিতে হলে সকলের জন্যেই নিতে হয়। আমরাও 
ওই আশ্রমেই থাকি কি না। 

ও। 

আবার চুপচাপ। বাইরে নাচের রেকঙ বেজে চলেছে সমানে । 
দপদ্প করছে নিয়ন। চৌরঙ্গীর সাহ্ধ্য-মদিরতা ঘন হয়ে 
কআসছে। 

আধ বুড়ী আযাংলে! ইত্ডিয়ান মেয়ে ঢুকল একটি । 

এত দেরি করলে মিস্‌ পার্কার? তোমার জন্যে একটু চা 
খেতে পর্বস্ত যেতে পারছি না, মীরার অনুযোগ শোন! গেল। 


বি 


সঃরিত। এবার যেতে পারো। তোমায় ছুটি ।--মিস্‌ পার্কীয 
শীরার পীগে এসে দাড়ালো । 

মীরা কুড়িয়ে নিলে ব্যাগটা । পাইথনের চামড়ার নকল 
ব্যাগ। পিছলে-পড়া শাড়িটাকে গুছিয়ে নিলে আর"একবার । 
বললে, চল বেণু; বেরুনো যাক। 

বেধু বেরুতেই চাইছিল হয়তো । রূং-বেরঙের খেলনাগুলো 
তার চোখে যেন খোঁচা! দিচ্ছিল বার বার। সঙ্গে সঙ্গই উঠে 
পড়ল, মীরা কাউন্টার থেকে ঘুয়ে বেরিয়ে আসবার আগেই 
রাস্তায় গিয়ে গ্লাড়ালো । 

চোখের একটা ইঙ্গিত করল মিস্‌ পার্কার । 

কে ও মেয়েটি ? 

আমার বন্ধু। 

পিয়োর ইনোসেন্স.।_একট! তির্যক হাসি ফুটল মিস পার্কারের 
ঠোঁটে £ স্পয়েলিং হার টু? 

বাজে বোকো না, চাঁপা ধমক দিয়ে বেরিয়ে গেল মীরা । 

ছ' পা এগিয়েই রেস্তোর? এবং বার । মীরা বললে, চল 
চা খাই। 

ওর ভেতরে ?--বেণু কুকড়ে গেল। মিছিল-কর! ছুঃসাহসী 
মেয়েটা কেমন ঘাবড়ে গেছে এখানে- চাঁপা জয়ের উল্লাস যেন 
অনুভব করলে মীর! । 

ভয় পাচ্ছিস ?£-- 

ভয় ঠিক নয়, তবে বেণু একবার দ্বিধা করল: তবে 
অভ্যেস নেই কিনা। 

চা খেতে অভ্যাস-অনভ্যাসের প্রশ্ন ওঠে না নিশ্চয় । চল-_ 

কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল ছু'জন। একবার বিহ্বল 
দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে দেখল বেণু। পা! ছটো জড়িয়ে আসতে 
চাইছে । এপাশে-ওপাশের টেবিলে দ্িশি-বিলিতী আাংলো ইণ্ডিয়ান 
পুরুষ-মেয়ে যার বসেছে প্রত্যেকের সামনেই রভীন গ্লীস। সেই 


৮৮ 


স্পিদ্িটের গন্ধের সঙ্গে চুরুটের ধোয়ার উগ্রতা মিশে দমচাপা 
আবহাওয়া একটা। 

কী বেমান্নান এখানে বেখু--কী অন্ভুত অসঙ্গত ! যে বেয়ারাটী 
টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছিল, তারও চোখে সেই বিস্ময়ের 
আভাস । 

মাথা নিচু করে বসেছিল বেণু--সেই ফাঁকে বেয়ারাটার সঙ্গে 
চোখোচোথি হয়ে গেল মীরার । নানা, ওসব নয়। গলা তুলে, 
বেণুকে শুনিয়ে শুনিয়েই যেন বললে, ছু* পেয়ালা চা, চিংড়ির 
কাটলেট । 

বেণু মাথা তুলল £ কাটলেট কেন ? চাই তো! যথেষ্ট । 

শুধু চাখাবি? এতদিন পরে এলি । 

কথ! বাড়াতে চাইল না বলেই শুকনে! যুখে বসে রইল বেণু। 
অপরিচিত অনভ্যন্ত আর-একটা কলকাতা । মীরার দোকানেই 
নয়, চারদিকেই এখানে খেলনার মিছিল। রভীন--ঝকৰঝকে। 
নানা রঙের গেলাস সামনে নিয়ে দূরে আর কাছের টেবিলগুলোতে 
ঘার! বসে আছে তারাও। এমনকি, মীরাও বুঝি একটা পুতুল 
ছাড়া কিছু নয়! বাস্তবিক বেণু এখানে বেমানান--বড় বেশি 
বেমানান । 

কী ভাবছিস ? _-মীরার প্রশ্ন । 

বেণু হাসল। 

ভাবছিলাম ও আবহাওয়া সহা করিস্‌ কী করে? ভালো 
লাগে? 

সব জিনিস কি আপনা থেকেই ভালো লাগে? লাগিয়ে নিতে 
হয়ঃ যেন নিজের বিরুদ্ধেই জোর করে জবাব দিলে মীরা । 

বেণু পায়ের কাছে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ । 
নিঃশব । লব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ছে, কলেজে 
ধনটার পুজা” অভিনয়ের সময় এই মীকাই নেমেছিল শ্রীমতীর 
ভূমিকায়। কী আশ্চর্য শুচিম্মিত মনে হয়েছিল-_-এখনো কানে 


৮ 


বান্ছছে /+নদ্ধ। খমতু মে। কিন্ত আজ আর কিছুই মিলছে না 
“কেমন যে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সমস্ত । 

তোর সে মহিলা আশ্রম কোথায় ? কলকাতায় 1 "-আবাম় 
'প্রশ্থ শোনা গেল মীরার । 

নাঃ বাইরে । বেলঘরিয়া থেকে যেতে হয়। 

পাড়ার্গায়ে? অস্থবিধে হয় না? 

একন্আধটু হয় বই কি। কলকাতার নুযোগ-স্ুবিধে তো আর 
পাওয়া যায় না, কী করা যাবে বল্‌? রিফিউজী মেয়েদের নিয়ে 
কাজ- সব রকম বাঁধার ভেতর দিয়েই চলতে হয় । 

চা আর কাটলেট নিয়ে এল বেয়ার।। 

নে, খা। 

কাটলেটের একটা টুকরে। মুখে দিয়েই বেণু ফর্কটা নামিয়ে রাখল। 

কী হুল? 

হয়নি কিছু ।--ফস করে একটা অশোভন প্রশ্ন করে বসল 
'বেণু £ আচ্ছা, কত বিল হবে এ-সব খাবারের ? 

তুলিতে অণকা জ্র-ছটো৷ একসঙ্গে জুড়ে এল মীরার £ এ-সর 
প্রশ্ন কেন হঠাৎ? 

এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম । কত বিজ দিতে হবে তোকে ? 

কত আর ?--একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল মীরা ঃ টাকা 
আড়াই বড় জোর । 

আড়াই টাকা !--বেণু 'যেন স্বগতোক্তি করল £ একরেল! হুধ 
হয়ে যেত আশ্রমের বাচ্চাঞ্চলোর । 

চাবুকের মতে! কথাট। গায়ে এসে লাগল। বেণু কি আঘাত 
করতে চায় তাঁকে ? ব্যক্ষ করতে চায় ওর রাজনীতির আভিজাত্য 
থেকে ? ক্রোধে অপমানে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল মীরা । সেলোফোন 
কাগজের মতো চোখ ছুটো চকচক করে উঠল। 

পৃথিবীতে অনেক ভালো কাজই করবার আছে। কিন্তু সবাই 
স্ব করতে পানে না। 


৮ 


ভা ঠিক ।--বেধু বিমর্ষ শল্গায় জায় দি, প্রতিবাদ ফরল, 
ন1। ভার পর কাটলেট! ফেলে রেখে, তিন চুমুকে চা-ট| শেষ 
করে ফেলল। অম্বস্তিভরে বললে, তুই ধীরেন্স্থে খা ভাই, 
আমি যাই। 

সেকি! কী হল তোর ?--কাটলেটের একট টুকরো ছি'ড়তে 
ছি'ড়তে থেমে গেল মীরা । 

সাতটা বেজে গেছে। আটটা! পাচের ট্রেনটা আমার 
ধরতেই হবে। ওদিকে অনেক কাজকর্ন আছে, তা ছাড়া নিজের 
বাচ্চাটাও কান্নাকাটি জুড়ে দেবে! ওরও বিস্তর ঝামেলা থাকে 
সন্ধ্যেবেলায়। 

মীরার মুখ কালো হয়ে গেল £ আচ্ছা যা তুই। 

রাগ করছিস 1 বেণু বিত্রত হানি হাসল: কী করব ভাই, 
কোনো! উপায় নেই আমার । শুধু একটা কথা আজ বলতে 
এসেছিলাম তোকে । তুই তো বেশ চাকরি-বাকরি করছিস আজকাল । 
কিছু সাহাষ্য কর্‌ না গরিব বাস্তহারাদের ৷ 

কালো মুখখানা আরও কালো হয়ে এল মীরার। নতুন 
মাইনে পাওয়া ব্যাগটাকে চেপে ধরল বাঁহাতের মুঠোর মধ্যে । 
একটু আগেই বেণু তাকে আঘাত করছিল, এবার সে প্রতিঘাত 
করবে । 

এ-মাসে পারব না ।-_ইচ্ছে করে শুনিয়ে শুনিয়েই মীরা বললে, 
ছুটে! নতুন শাড়ি কিনতে হবে আমাকে । দেখে রেখেছি মার্কেটে । 

ছিটের ময়লা! ব্লাউজ আর ডুরে শাড়ি-পরা বেণু সপ্রতিভ 
হাসি হাস £ বেশ, তা হলে আমার বাচ্চাদের জন্যে না হয় 
কিছু খেল্নাই ডোনেট কর। 

গলার স্বরে যথাসম্ভব তিক্ততা মিশিয়ে মীরা বললে, দোকানের 
মালিক আমি নই, মিস্টার পালিয়া | তার জিনিস নিয়ে চ্যারিটি 
করবার জন্যে ছিনি আমার চাঁকরি দেন নি। 

অদ্ভুত নিলজ্জ বেগু তবু দমল নাঃ আচ্ছা, তা হলে কিছু 


৮৩ 


টাকাই দিস "আসছে মাসে। আমি আবার আসব + দরজার 
দিকে পা এগিয়ে গিয়ে ফিরে তাকালো! একবার £ কিছু মনে 
করিস মি ভাই, আটটা পীচের টট্রেনটা ধরতেই হবে আমাকে । 

ময়লা কাবলী জুতোর শব্দটা নেমে গেল বাইরে । 

হিং চোখে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল মীরা । তার পর 
চিংড়ির কাটলেট্টাকে আশ্চর্য বিস্বাদ মনে হল তার। চায়ে 
চুমুক দিয়ে দেখল জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে সেটা । 

অদ্ভুত তীক্ষ গলায় মীরা ডাকল ঃ বোয় ! 

বয় আসবার আগেই যেন আকাশ থেকে একটি পাঞ্জাবী 
ছোকরা নেমে এসে বেণুর চেয়ারটায় বসে পড়ল। মীরাকে 
চেনে। তার দিকে তাকিয়ে শ্বাপদের মতো! রক্তিম একটুকরো! 
হাসি ফুটে উঠল মীরার ঠোটের কোনায়। এ হাসি আলাদা_ 
দোকানের কোনো খরিদ্ধার কখনো দেখে নি- বেণুও না। 


আরও দেড়ঘণ্ট পরে । 

শুধু চারদিকের নিয়নগুলোই দপ্‌দপ করছে না মীরার 
রক্তেও আগুন জ্বলছে, চোখছুটোও জ্বলজ্বল করছে-_কিস্তু ধার-করা 
উজ্জলতাঁয় নয় । এ চোঁখ বেণু দেখেনি-_দেখবার সাহসও নেই বেণুর । 

হঠাৎ মীরার হেসে উঠতে ইচ্ছে করল। আশ্রম__বেলঘরিয়া 
জংলা পথ দিয়ে থমথমে অন্ধকারে ছেড়া কাবলী জুতোয় হোঁচট 
খেতে খেতে বেণু হয়তো হেঁটে চলেছে এখনো । দূর থেকে হয়তে। 
তাঁর শিশুর কান্নাই শুনতে পাচ্ছে সে। আর কত আলো! এখানে-_ 
কী অজ আলো! এ আলোয় একটা ছুশ্চ মাটিতে পড়ে গেলেও 
কুড়িয়ে পাওয়া যায়। কিন্তু _কিস্ত-_হঠাৎ গলায় একটা কাঁটা 
বেধার মতো মনে গড়ল : অথচ একটি পরিচয়হীন শিশু কোন্‌ 
অনাথ আশ্রমে এ আলোয় হারিয়ে বায় কেউ ভার সন্ধানও 
পায় না! চারদিকের শব্দের ঘৃমি ভেদ করে তার কান্না এসে 
গ্কবারও স্পর্শ করে না মীরাকে । 


৮৪ 


থমকে ধীড়িয়ে গেল। সামনেই "তার দোকান। এখন বন্ধ 
হয়ে গেছে। শুধু শৌকেসেন্ন উজ্দ্রল আলোয় ঝকবক করছে কয়েকটা 
খেলন! £ একট! ডল্গ-_-ছুটো মেকানে! সেট, কতকগুলো! প্লীস্টিকের 
খু'টিনাটি-_একট! কর্ক-গান ! 

খেস্নাগুলোর দিকে তাকিয়ে কেমন যেন হঠাৎ দম বন্ধ হায়ে 
এল মীরার। বেণুর জন্যে এর। নয়। কিন্তু গোত্রহীন যে শিশু 
অজানা অনাথ আশ্রমে ঠাই পেয়েছে, তারও কি এতটুকু দাবি আছে 
এদের উপর « 

একবার বোবা যন্ত্রণায় ঠেঁচিয়ে উঠতে চাইল মীরা । মনের 
মধ্যে থেকেও আর্তনাদের মতো! প্রন্ন উঠল ঃ বেলঘরিয়া যাওয়ার 
এখনো কি কোনো ট্রেন আছে? এখনো কি আশা আছে তার ? 
এখনো ছুটে গিয়ে বেণুকে কি বলা যায়_ 

না__যায় না। বড় অন্ধকার। সে অন্ধকারে শুধু বেণুরাই 
পথ চলতে পারে--মীরা পারবে না। চারদিকের আলো- রাশি 
রাশি উগ্র আলো মদের নেশার মতোই খেলা করে বেড়াচ্ছে 
তার রক্তে । এর হাত থেকে তাঁর পরিত্রাণ নেই ! মরণের কাছে 
দাসখৎ দেওয়। পৌঁকার মতো। এই আলোর বৃত্ত পরিক্রম। ছাড়। 
উপায়াস্তর নেই তার । 

কিন্ত বেণুর অন্ধকারের শেষে তো একটা আশ্রয় আছে। 
এই আলোর শেষে? এই উজ্জল নিলঞ্জতার শেষ সীমান্তে কী 
আছে মীরার জন্যে ? 

কাচের শো-কেস্টাই আপাতত ভেঙে ফেলতে পারে মীরা-_ 
ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারে খেলনাগুলো। আর-_ আর. তুলে 
নিতে পারে কর্ক-গানটাকে। কিন্তু মীর এও জানে ; কর্ক-গান 
থেকে শুধু শব্দ আর ধেোঁয়াই বেরিয়ে আসে, তার বেশি আর 
কিছুই হয় না। 


৮৫ 


পাস্-নিবাস 


কী দাদা, ঘুম ভাঙল ? 

প্রশ্নটা অনাবশ্যক, কারণ দাদা নিশ্চয়ই এই সকাল সাড়ে 
ইটায় ম্মুমস্ত অবস্থায় দরজা খুলে প্রকৃতির শোভা দেখছেন ন!। 
আরও বিশেষ করে ভার গায়ে যখন একখান! শাল জড়ানো 
এবং হাতে একটা জ্বলন্ত চুরট। কিন্ত দাদা আশ্চর্ধ হলেন না। 
প্রাত্যহিক আলাপের অভ্যন্ত ভূমিকার সঙ্গে তিনিও সৌজন্যের 
দস্তরুচি বিকাশ করলেন। 

রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো! 

মন্দ নয়--এবার উত্তর দিয়ে দাদা অনুজকে কৃতার্থ করলেন। 

বল! দরকার, এখানে দাদাত্বের সঙ্গে বয়সের কোনো সম্পর্ক 
নেই। 'মশায়ের” প্রথম ধাপটা পেরুলেই মিউচুয়্যাল প্দাদায়ন। 
অস্তরঙ্গতার অকৃত্রিম অভিব্যক্তি । বাঙালীর জাতীয় এঁতিহা। 

টাইগার হিলে যাবেন নাকি কাঁল সকালে ? 

আজ আকাশের অবস্থাটা দেখি একবার। বৃষ্টি হবে না বোধ 
হচ্ছে। কী বলেন? 

ওয়েদার তো৷ ভালোই যাচ্ছে কাল থেকে । তবে দাজিলিঙের 
ব্যাপার তোঁ-ডেফিনিট বলা যায় না কিছুই। ভালো কথা-_ 
গরম কোটট। তৈরি হয়ে গেছে আপনার ? 

চা খেয়েই বেকব ট্রায়াল দিতে । চলুন না একবার সঙ্গে। 
আপনার তো৷ এক্সপার্ট চোখ ! 

পলাজিলিং শহরে মে মাস। একটি পান্থশীলায় প্রভাতী জাগরণ । 

ব্যারাকের মতো রকৃটার সামনে দিয়ে কাঠের লম্বা করিডোর 
কাচের আভরণে ঢাকা । ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অধচন্ত্রাকার 
একটি লাউঞ্জ-_কয়েকটি বসবার আসন। সেইখান থেকেই কথাঙ্গাপ 
কানে আসছিল। 


৮৬ 


কন্লের উত্বপ্ত আঁভ্রয়ে জাতধা এুঁমের ভেতরেই আলাপ” 
আলোচনা শুনছিলাম । কিন্ত আর জন্বমান থাকা গেল না বেশিক্ষণ ॥ 
হঠাৎ ছম্দাম্‌ শব্দে সমস্ত বলক্টণ কেপে উঠল--.মনে হল হস'রেন 
শুরু হয়ে গেছে করিভোরটার পরে । নাঘোড়া নয়। এক 
নম্বর আর হু-নন্বর ঘর থেকে মাড়োয়ারী পরিবারের সেই উত্ভতরকাল 
বেরিয়ে এলেন--ধাদের জন্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন--“ইহাদের 
করো আশীর্বাদ । রবীন্দ্রনাথ আরও জানিয়েছিলেন যে এরাই 
'নল্গনের এনেছে সংবাদ । 

এরাই যদি 'নন্দনের' বার্ভতাবহ হয়ে থাকে, তবে নন্দন সম্পর্কে 
খুব উৎসাহিত হওয়ার কারণ নেই--আমি বলতে বাধ্য । পদধ্বনি 
দিয়ে শুরু হয়েছে, তার পরিণতি ঘটবে অমানুষিক চিংকারে এবং 
আন্ুুরিক কান্নায়। মুতরাং উত্তিষ্ঠত জাগ্রত। 

সামনে করিডোরের পর্ব চলতে থাকুক-আমি দরজা! খুলে 
পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। পাস্থশালার এ অংশটুকু 
হরিজন। সারি সারি বাথরুমের তল দিয়ে খোল! ড্রেন। তার* 
পরেই তিন-চার হাত চওড়া জমি একটা আকম্মিক খাড়াইয়ের 
মধ্যে ফুরিয়ে গেছে। আকাশ যেদিন পরিষ্ষার থাকে--সেদিন 
অবশ্য এখান থেকে ভারী চমৎকার দেখায় কাঞ্চনজজ্ঘাকে। দল 
বেঁধে সবাই জড়ো হয়, বাইনোকুলার ঘ্বুরতে থাকে হাতে হাতে, 
ক্যামেরার শব্দ ওঠে ক্লিকৃ ক্লিক। কিন্ত আজ সামনের আকাশটা 
নিবিড় কুয়াশা! দিয়ে ছাওয়া-কণায় কণায় জল নিয়ে ফগ, উড়ে 
আসছে-_ খানিক দূরের পাইন গাছগুলো পুরোনে। দীঘির জলের 
তলায় কালো শ্যাওলার মতো অস্পষ্ট । 

একা দাড়িয়ে কিছুক্ষণ নিশ্বাসে নিশ্বাসে ফগ. টানা গেল। 
বন্ধ ঘরের গুমোট চাপটা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে যেন 
ফুস্ফুস্‌ থেকে । শিরশিরে হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছে মাথাটা । 

কিন্ত না--এখানেও দীড়াঁতে দিল না। 

তিন নম্বর ঘরের পাঞ্জাবী মেয়েটির সঙ্গে ছ-নম্বরের মারাগী 


৮৭ 


পান্থ-নিবাস 

কী দাদা ঘুম ভাঙল? 

প্রশ্নটা অনাবশ্যক, কারণ দাদা নিশ্চয়ই এই সকাল সাড়ে 
ছটায় 'ঘুমস্ত অবস্থায় দরজ! খুলে প্রকৃতির শোভ! দেখছেন না । 
আরও বিশেষ করে তার গায়ে যখন একখানা শাল জড়ানে। 
এবং হাতে একট! জ্বলস্ত চুরুট। কিন্তু দাদা আশ্চর্য হলেন ন]। 
প্রাত্যহিক আলাপের অভ্যস্ত ভূমিকার সঙ্গে তিনিও সৌজন্যের 
দস্তরুচি বিকাশ করলেন । 

রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো ? 

মন্দ নয়-_এবার উত্তর দিয়ে দাদ! অন্থুজকে কৃতার্থ করলেন । 

বলা দরকার, এখানে দাদাত্র সঙ্গে বয়সের কোনো লম্পর্ক 
নেই। “মশায়ের” প্রথম ধাপটা পেরুলেই মিউচুয়্যাল 'দাদায়ন”। 
অস্তরঙ্গতার অকৃত্রিম অভিব্যক্তি । বাঙালীর জাতীয় এঁতিহা। 

টাইগার হিলে যাঁবেন নাকি কাল সকালে? 

আজ আকাশের আবস্থাটা দেখি একবার । বৃষ্টি হবে না বোধ 
হচ্ছে। কী বলেন? 

ওয়েদার তে। ভালোই যাচ্ছে কাল থেকে । তবে দাজিলিঙের 
ব্যাপার তো-_ডেফিনিট বল! যায় না কিছুই। ভালে! কথা-_- 
গরম কোটটা তৈরি হয়ে গেছে আপনার ? 

চাঁখেয়েই বেরুব ট্রায়াল দিতে । চলুন না৷ একবার সঙ্গে। 
আপনার তো৷ এক্সপার্ট চোখ ! 

দীর্জিলিং শহরে মে মাস। একটি পাস্থৃশাঁলায় গ্রভাতী জাগরণ। 

ব্যারাকের মতে। ব্লক্টার সামনে দিয়ে কাঠের লম্বা করিডোর 
_-কাচের আভরণে ঢাকা । ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অধচন্ত্রাকার 
একটি লাউপ্ল-_কয়েকটি বসবার আসন। সেইখান থেকেই কথাঙগাপ 
কানে আসছিল। 


৮৬ 


কম্বলের উত্বপ্ত আশ্রয়ে আধে ঘুমের ভেতরেই আলাপ" 
আলোচনা শুনছিলাম । কিন্ত আর লম্বমান থাকা গেল ন। বেশিক্ষণ । 
হঠাৎ ছুম্দাম্‌ শব্দে সমস্ত ব্লক্টা কেপে উঠল--মনে হুল হসরেস 
শুরু হয়ে গেছে করিভোরটার ওপরে । না--ঘোড়া নয়। এক 
নম্বর আর হ্‌-নম্বর ঘর থেকে মাড়োয়ারী পরিবারের সেই উত্তরকাল 
বেরিয়ে এলেন--ধাদের সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-__“ইহাদের 
করো৷ আশীর্বাদ । রবীন্দ্রনাথ আরও জানিয়েছিলেন ষে এরাই 
নন্দনের এনেছে সংবাদ” । 

এরাই যদি “নন্দনের' বার্তাবহ হয়ে থাকে, তবে নন্দন সম্পর্কে 
খুব উৎসাহিত হওয়ার কারণ নেই--আমি বলতে বাধ্য । পদধ্বনি 
দিয়ে শুরু হয়েছে, তার পরিণতি ঘটবে অমানুষিক চিংকারে এবং 
আস্ুরিক কান্নায় । সুতরাং উত্তিষ্ঠত জাগ্রত। 

সামনে করিডোরের পর্ব চলতে থাকুক--আমি দরজা খুলে 
পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। পাশ্থশালার এ অংশটুকু 
হরিজন। সারি সারি বাথরুমের তল দিয়ে খোলা ড্রেন। তার- 
পরেই তিন-চার হাত চওডা জমি একটা আকস্মিক খাড়াইয়ের 
মধ্যে ফুরিয়ে গেছে। আকাশ যেদিন পরিক্ষার থাকে--সেদিন 
অবশ্য এখান থেকে ভারী চমৎকার দেখায় কাঞ্চনজজ্ঘাকে। দল 
বেধে সবাই জড়ে। হয়, বাইনোকুলার ঘুরতে থাকে হাতে হাতে, 
কামেরার শব্দ ওঠে ক্লিক ক্লিক। কিন্তু আজ সামনের আকাশটা 
নিবিড় কুয়াশ। দিয়ে ছাওয়া-_-কণায় কণায় জল নিয়ে ফগ উড়ে 
আসছে-_খানিক দূরের পাইন গাছগুলো পুরোনো দীঘির জলের 
তলায় কালো শ্যাওলার মতো! অস্পষ্ট । 

একা দাড়িয়ে কিছুক্ষণ নিশ্বাসে নিশ্বাসে ফগ. টাঁনা গেল। 
বন্ধ ঘরের গুমোট চাঁপটা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে যেন 
ফুস্ফুস্‌ থেকে । শিরশিরে হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছে মাথাট!। 

কিস্ত না--এখানেও দাড়াতে দিল না । 

তিন নম্বর ঘরের পাঞ্জাবী মেয়েটির সঙ্গে ছ-নম্বরের মারাঠী 


৮৭ 


ছেঞ্সেটি একটু বেশি অস্তরঙ্গভাবে ধ্রাড়িয়ে। ওধের নিয়ে কিছু 
দিন থেকেই একটা চাপা কানাকানি চলছে পাস্থ-নিবাসে। আরও 
শোনা গ্মাছে, ভীমকায় পাঞ্জাবী পিতৃদেব এই পূর্বরাগটুকু আদৌ 
পছন্দ করেন না, কারণ কলকাতায় কোন্‌ মোটর-ব্যবসায়ীর সঙ্গে 
নাকি ইতিপূর্বেই মেয়েটি বাগ.দত্তা | 

কিন্ত ওটা! পারিবারিক ব্যাপার--আমার আওতায় পড়ে না। 
আমি কেন অকারণে ছন্দপতন ঘটাই ওদের বিশ্রসম্ত-বিলাসে ? 
অগত্যা বাথরুমে হাত মুখ ধুয়ে আবার ফিরতে হল করিডোরের 
দিকেই 

সাগনে মস্ত লন। সীজন ফ্লাওয়ার, গন্ধহীন গোলাপ আর 
তোড়ার মতো। থোকা বাঁধা নীল-শাঁদ] হাইড্রেন্জিয়! । ছুটো চারটে 
ক্যাক্টাস্--তাদের একটায় ম্যাগনোলিয়ার মতো সমস্ত একটা শাদা 
ফুল ফুটেছে । ডালিয়ার ছেড়া পাপড়ির মতো উড্ভন্ত প্রজাপতি 
মাথার ওপরে একদিকে রেলস্টেখশনে এপ্িনেব ধোয়া অন্যদিকে 
সা'রি সারি পাইন গাছের ছায়ায় একটা বোদ্ধ গুন্ফার গম্ভীর মুন্তি। 

কিন্ত সুর কেটে যায়। তখনি চোখে পড়ে ঠিক স্টেশনের 
নিচেই খানিকটা! ভাঙাচুরো। বাঁধানো জায়গা-_-একটা বাড়ির 
ধ্বংসাবশেষ । দাঁজিলিডের বিখ্যাত ধসের সময় একটি গরীব 
বাঙালী রেলের কেরানী ওখানে নিশ্চিহ্ন হযে গেছে সপরিবারে । 
ডেমোক্লিসের তলোয়ারের মতো! অশুভভাবে ওটা ছাড়িয়ে আছে 
মাথার ওপরে । অন্বস্তি লাগে-_নামিয়ে আনতে হয় দৃষ্টি । 

ওদিকের আর-এক ব্লক থেকে বাসম্তী রঙের শাড়ি পরা একটি 
মেয়ে উদ্াসিনীর মতো৷ লনে নেমে এল । গায়ে ফিকে নীল একটি 
ওভারকোট--কিস্তু বোতাম জীাটা হয় নি। ফোটের পকেটে হাত 
দিয়ে মন্থর গতিতে পায়চারি করতে লাগল । 

কোনো এক দিস্‌ রায়। স্বাধীন এবং ম্বাবলম্বিনী। দিনের 
মধ্যে বার দশেক শাড়ি বদলান--অস্তত গোটা তিনেক কোট 
পরতে দেখা গেছে ওঁকে । চলাফেরার মধ্যে একটা উদাস বিরহ 


৮৮ 


গ্নিয়ে থাকে সব সময়ে । দেখে মনে হয়, হয় প্রেমে পড়েছেন 
নইলে ভূগছেন টি-বিতে । | 

কিন্ত সত্যি নয় কোনোটাই । কারণ পাশ্থশীলার ক্লাধ ঘরটিতে 
উনি মক্ষিরানী। সেখানে একদল ছোকরার সঙ্গে কোলাহল করে 
“টেবল-টেনিস খেলেন, অকৃপণ হাসির করুণা-কণ! বিতরণ করেন 
সকলকেই । কোনো কোনে দিন বন্ধুদের নিয়ে নাকি ওঁকে “বারে, 
ঢুকতে দেখ! যায় এবং মুখে থাকে জ্বলস্ত সিগারেট । 

দাড়িয়ে দাড়িয়ে অন্যমনস্কভাবে মেয়েটিকেই দেখছিলাম । বেশ 
রোম্যান্টিক লাগছে অস্ষচ্ছ সকালের আলোয় । কিন্ত সামনা-সামনি 
যে ছু-চারবার ভদ্রমহিলাকে দেখেছি, সঙ্গে সঙ্গেই কুঁকড়ে গেছে 
সমস্ত মন। স্বাচ্ছন্দ্যে সঙ্গে নির্ুুদ্ধিতা মিশলে একটি নুরী মেয়ের 
মুখও কত কুৎসিত দেখাতে পারে-_তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন যেন। 

ও লা- লালা 

গগনভেদী চিৎকার একটা। ট্রাউজার আর বুশ শার্টের 
ওপরে সিপি-ওভার চড়িয়ে ছুটি তেইশ চবিবশ বছরের ছেলে যেন 
হঠাৎ আকাশ থেকে আছড়ে পড়ল লনের ওপর। একজনের 
হাতে একটা সিগারেটের টিন-_সেইটে নিয়ে উত্বশ্বীসে সে ছুটছে 
_-আর একজন প্রীণপণে তাড়া করছে তাকে । 

মাইরি দিয়ে দে বলছি। ভালে! হবে না নইলে-_ 

কেন, বাজী রাখবার সময় মনে ছিল না? এটা এখন আমার-_ 

ছু'জনে হাত কাড়াকাড়ি আরম্ভ করল। একট! বীভৎস তাণ্ডব 
শুরু হয়ে গেল বলতে গেলে । 

মিস্‌ রায় দ্শড়িয়ে মিটমিট করে হাসছিলেন। যে ছেলেটির 
হাতে সিগারেটের টিন, সে হঠাৎ নাটকীয় ভঙ্গিতে তার সামনে 
গিয়ে ঠাড়ালো। পু 

এই যে আপনি রয়েছেন । আপনিই বিচার করুন-_ 

লাউঞ্জের মধ্য থেকে ট্যা করে কান-ফাটানো কান্নার আওয়াজ 
উঠল একটা । মাড়োয়ারী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এতক্ষণ বাহুবল 
পরীক্ষা চলছিল, এইবারে একজন বিধ্বস্ত হল। 


ঙ৬ ৮৪ 


এ গ্মুম.-এ সর্ধুঁ 

স্বত্বাধিকারী অভিভাবকের একটা খ্যারখেরে গলার ধমক 
শুনতে পাওয়া গেল। 

শিশুপাল বধ দেখব, না লনের নাটকটা উপভোগ করব ঠিক 
করার আগেই ট্যাং ট্যাং করে ঘণ্টা বাজল। ডাইনিং হলে প্রভাতী 
চাঁপানের আহ্বান । তৃষ্তার্ত চাতকের মতো ছুটলাম সেদিকেই । 


গৌরবে বছবচন। ডাইনিং হল। ঘরটির চেহারা কলকাতার 
পাইস্‌ হোটেলের চাইতে লোভনীয় নয়। মেজেতে সারি সারি লম্বা 
লম্বা সিমেন্টের বেদী--তাদের গায়ে গায়ে বিজ্ঞপ্তি লটকানো £ 
ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈগ্য, নবশাখ ইত্যাদি । অর্থোডক্স ব্লকে আমরা 
আছি, এক জাত আর-এক জাতের সঙ্গে পডঙ্‌ক্তি ভোজন করে পৈতৃক 
ধর্মকর্ম নষ্ট না করি, তারি জন্যে এই সতর্কতা । আগে খুব কড়া- 
কড়ি ছিল, এখন আর পঙ্ক্তির নিয়মট। কেউ মানে না। 

কিন্ত গীতায় যখন শ্রীভগবান গুণ-কর্ম বিভাগ করেছিলেন, তখন 
চা-পান সম্বন্ধে কিছু বলে যান নি যুযুতস্থ অর্জনকে । সুতরাং এহেন 
অর্থোডক্স ভোজনশালাতেই শ্লেচ্ছমতে চা-পানের ব্যবস্থা করতে হয়েছে । 
ঘরের তিনদিকে কাঠের দেয়াল ঘেষে বইয়ের শেলফের মত সরু সরু 
কাঠের ফালি সমাস্তরালভাবে বসানো । ভোজনপর্ব মেজেতে বসে 
সারতে হয় বটে, কিন্তু চায়ের বেলায় এই কাঠের দাড় উঠে বসতে হয় । 

কড়াইশু'টি সহযোগে চি'ড়ে ভাজা । ফ্রুট নামে ছু-টুকরে। 
পেঁপে আর একটা ছোট মিষ্টির টিফিন এল। সেই সঙ্গে বেশ 
বড় সাইজের পেয়ালায় চা। 

আহারে মনোনিবেশ করি। একটি আস্তর্জাতিক সমাবেশ 
চারপাশে । পাঞ্জাব-সিঙ্কু-গুর্জর-মারাঠা-দ্রাবিড়-বঙ্গ । উৎকলটা বাদ 
গেল-_-উৎকলীয় কেউ আছেন কিনা এখনো চোখে পড়ে নি। 

চিড়ে-ভাজা চিবোনোর একটা দাস্তিক একতান। ব্যতিব্যস্ত 
পাহাড়ী বেয়ারাগুলোর প্রতি নানা গলার ধমক £ চা লাও, 
টিফিন লাও। তারি ভেতরে আবার মাতৃভাষায় আলাপচারী শুনছি । 


১, 


কাল ওজন নিয়েছিলেন দাদা? ক-পাউণ্ড বাড়লো ? 

গাঁলটায় একটু গোলাগী রঙ. ধরেছে এই ক-দিনে--কী বলেন ? 
কাল আয়নার সামনে দাড়িয়ে লক্ষ্য করলুম। 

আজ পেটের অবস্থা কেমন আপনার ? সারলো ? 

কই আর সারলো ! এখনো ভূট্ভাট করছে। তার উপরে 
খাচ্ছি চি'ড়ে ভাজ।। কী হবে কেজানে। 

চি'ড়ের দোষ নেই মশাই--ওতে কিছু হবে না। তখন তো 
কথা শুনলেন না। এত পইপই করে বললুম, দাঁদা, এখানকার কাচা 
জল খাবেন না_খাবেন না। বেজায় ভেঞ্জারাস্‌। তখন কানেই 
তুললেন না বুঝুন এবার । 

কী করি বলুন তো? হিল ভাইরিয়া-ফাইরিয়া হবে না তো 
শেষ পর্যন্ত ? 

বেশ লাগছিল- হঠাৎ “ধ্বনি তরঙ্গিল নিবিড়-সংগীতে 1 বঝন্ঝন্‌ 
করে একটি কাপ পড়ল মেঝেতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, এধারের 
ভদ্রলোকটি উচ্ছলিত গরম চায়ের স্পর্শস্থখে আর্তনাদ করে উঠলেন । 

ব্যাপারটা সংক্ষিপ্ত । চায়ের ঘণ্টার আওয়াজে করিডোরের 
সংগ্রাম পর্ব থেমেছিল সাময়িকভাবে । কিন্তু টেবিলে বসে আট 
বছরের হনুমান দাস একটা ঘুষি হাকড়েছে ছ-বছরের মুন্নলালের 
উদ্দেশে । ঘুষিটা লক্ষ্যত্রষ্ট হয়ে লেগেছে চায়ের কাপে এবং তারপর-_ 

চাঁহত ভদ্রলোক আহত হদয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে 
গেলেন। সম্ভ ধোপ-ভাঙা পাজামাটায় এখনি সাবান দিলে হয়তো! 
কিঞ্চিৎ আশা আছে। 

ঘরের তত্বাবধায়ক হাঁড়ির মতো মুখ করে এগিয়ে এলেন । 

দেখিয়ে জী, রোজ এক্‌ঠো এক্‌ঠো করে এইসা কাপ ভাংনেসে-_ 

হনুমান দাসের পিতৃদেব চটে উঠলেন £ তোড়া তে। হুয়া ক্যা? 
লড়কা লোক ত্যায়সা করতাই হ্যায়। যাও-_যাও-_হাঁমর! ঘর্মে 
তুমার কাঁপকো৷ বিল ভেজ দে 

টাদির জুতো । তত্বাবধায়ক বিড়বিড় করতে করতে সরে গেলেন, 
ওঃ-_-ভারী গরম হয়েছে টাকার ! 


এ 


উঠে পড়ি। এবার একটু বেরুতে হবে। 

লনের ভেতর দিয়ে ঘরে ফিরছি, সঙ্গ মিল্গে স্টোন ব্লকের 
কাঞ্চন বাঁড়ুয্যে। 

বিএএ পরীক্ষা দিয়ে বেড়াতে এসেছে দাঞ্জিলিঙে। অনাস-পড়া 
ভালো ছাত্র--ফেলের ছুর্ভাবনা নেই। কবিতা! লেখবার বাতিক আছে। 
কলকাতায় বন্ধুদের কাছে আমল পায় না, ঠিক করেছে, ছু-মাস 
দাজিলিডে থেকে অমর কাব্য রচনা করে নিয়ে যাবে । 

কি হে কাঞ্চন, নতুন স্যষ্টি হল কিছু ? 

কাল রাত ছুটে পর্যস্ত লিখেছি দাদা । ছ'টা কবিতা। 

বলো কী! এই শীতের মধ্যে রাত ছুটো পর্ষস্ত কাব্যচ্চা ! 

কী করব দাদা? কাঞ্চন প্রায় আধ্যাত্মিক হাসি হাসল £ 
হঠাৎ সুভ এসে গেল। যতই থামতে চাই, কিছুতেই আর কলম 
থামে না। কাচের জানলার ভেতর দিয়ে আতশবাজির মতো 
যতই বাইরের আলোগুলোর দিকে তাকাই, ততই আইডিয়াগুলো 
একটার পর একট! সার দিয়ে এসে চীড়ায় ।--অপরাধীর গলায় 
কাঞ্চন বললে, ছ-একটা শুনবেন দাদা ? 

এখন নয় ভাই- _সম্ত্স্তভাবেই জবাব দিই £ একটু বেরুতে হবে। 

কাঞ্চন নিরাশ হয় বটে, কিন্তু দমে যায় নাঃ আচ্ছ! ছুপুরে 
হবে তাহলে । 


আকাঁশ মোটামুটি পরিক্ষার, রৌদ্র আর কুয়াশার খেল 
চলেছে । কাঁঞ্চনজজ্ঘা আধঘন্টার জন্যে একটুখানি দেখ দিয়েছিল, 
এখন আবার হারিয়ে গেছে একটা নিশ্ছেদ শাদ1! পদর্ণর আড়ালে । 

ম্যালে উঠে এলাম । 

বসবার জায়গা একটিও খালি নেই। নানারঙের কোট, 
ওভারকোট, ছাতা আর বর্ধাতির মেল! বলেছে । কয়েক বছর 
আগেও ধুতি-চাদর চোখে পড়ত-_এখন তারা নির্বাসিত বললেই হয়। 

অশ্বারোহণের বিচিত্র অধ্যায় আশেপাশে । চল্লিশ বছরের 
ভূঁড়ো ভত্রলৌক খর্বকায় টা্ুর পিঠে কম্পমান- তেরো-চৌদ্দ 


৯ 


হছরের একটি ভূটিয়া মেয়ে ঘোড়ার লাগীম ধরে ডাকে আশ্বান 
দিচ্ছে। সামনের সাঁজানো দোকান থেকে মনোহারী জিনিসের 
হাতছানি । ঝকঝকে মেয়েদের ধারালো হাসির কল-ঝংকার। 
দামী গরম জামা গায়ে চড়াবার একট প্রাণাস্তিক প্রতিযোগিতা । 

শুধু সাড়ে ছ-হাজার ফুট নয়, তারও চেয়ে অনেক ওপরে 
এই দাজিলিং। এখানে এলে মনে হয় আকাশট! মাথায় অনেক- 
খানি কাছাকাছি এসে পড়েছে_কেমন করুণা হয় সমতলের 
মানুষগুলোর ওপরে । এই মুহুর্তে বাংলাদেশের রোদে পোড়া 
মাঠকে মনে পড়ে না-_ছুভিক্ষের ছায়া-নামা গ্রামগুলোকে তুলে 
যাওয়া চলে, ভূলে যাওয়া চলে ঠিক এই বেলা এগারোটার 
সময় বীরভূমের আর বাকুড়ার মানুষ শুকনো পাহাড়ী নদীর গরম 
বালু খু'ড়ছে তৃষ্ণার জলের আশায় । মনেই থাঁকে না, মধ্যবিত্ত ঘরের 
ম্যাট্রিক পাঁস মেয়ে চাকরির চেষ্টায় ঘুরতে বেরিয়ে এই মুহুর্তেই 
অসহ্য গরমে একটা বাস স্ট্যাণ্ডের পাশে অচেতন হয়ে পড়ল-_ 
কাল রাত থেকে ঘরে তার খাবার ছিল না! 

হংসের দলে বকের মতো ঘুরতে থাকি । আমার পরনে ধুতি 
--টুইডের লম্বা কোটটা কুলীন জাতের নয়, আকারে প্রকারে 
ধুশো কম্বলের সগোত্র। পায়ের কাঁবুলী চটি দীনতায় শ্লান। 
চারদিক থেকে যেন অনুকম্পার দৃষ্টি এসে আমাকে আঘাত করছে। 
ম্যাল্‌ থেকে সরে পড়লাম । 

নিচের বাজারমুখী রাস্তাটা দিয়ে নামছি, এমন সময় সম্ভাষণ ঃ 
কী দাদা, এখনি ফিরছেন যে বড় ? 

পাস্থ-নিবাসের আর একটি । বছর পয়ত্রিশ বয়স, গোলগাল 
মুখ, ফস রং-_মাথার সামনের দিকে ছোট একটি টাক। জেনারেল 
ব্লকে থাকেন-__দিলদরিয়া লোক। সব সময়ে চার-পাচ রকমের 
সিগারেট রাখেন সঙ্গে-অফার করেন অকৃপণভাবে। পেশায় 
আযাটনি, কিন্ত আাটনিগিরি করবার দরকার হয় না। বাপের 
টাকা আছে, দিদিমা নাকি সাতখান। বাড়ি দিয়ে গেছেন। 

ভদ্রলোক কী এক মিস্টার চাকলাদার । শোনা যায় তিনি 


৩ 


নাকি অতিশয় রসিক। আমি অবশ্থঠ তাঁর সেই রসিকতার বিশেষ 
কোনো পরিচয় পাই নি। শুনেছি, মেয়েশমহলেই নাকি তার ছূর্দাস্ত 
পসার এবং কলকাতার একটি অঞ্চলে নাকি তার অনুয়াগিনীর 
সংখ্যা আঙ্লে গুণে শেষ করা যায় না। 

চাকলাদারকে কোনো জবাব দেবার আগেই তিনি ধা! করে 
একটা চৌকো! সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন আমাকে £ নিন্‌ দাদাঁ_ 
ইজিপ সীয়ান্‌ ব্লেন্ড, ! 

নিলাম। ফস্‌ করে লাইটারটা তিনিই জ্বেলে ধরলেন । তার পর 
আতিথেয়তা শেষ করে জিজ্ঞেস করলেন £ ম্যালে নতুন কাকে 
দেখলেন আজ ? 

মানে? 

ডলি লাহিড়ীদের আসবার কথা ছিল, মিসেস্‌ মিত্রও আসবেন 
রুবি আর ববিকে নিয়ে, তা ছাড়া কনে'ল চ্যাটাজির মেয়ে সবিতারও 
আসবার খবর শুনেছিলাম ওর ফিয়ার্সে'র সঙ্গে । দেখলেন কাউকে ? 

মাপ করবেন, ঠিক বলতে পারব না । ওঁদের কাউকেই আমার 
চেনা নেই। 

তা বটে, ওদের চেনা যায় না দে আর্‌ এভার সো মিস্টিরিয়াস ! 
চাকলাদার এবার হা হা করে হাসলেন, সম্ভবতঃ এইটে তার বিখ্যাত 
রসিকতার একটি। তার পর হাসি থামিয়ে বললেন, চলুন না, ছু- 
একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই । 

আর একদিন হবে, আজ থাক। আমি সবিনয়ে পাঁশ কাটালাম । 
একটা বিলিতী সুর শিস্‌ দিতে দিতে চাকলাদার চললেন ডলি 
লাহিড়ীদের সন্ধানে । 

পাস্থ-নিবাসে পা দিতে দেখি, আর একটা নতুন পর্ব শুর 
হয়েছে । লন জুড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করছে এখন । 
লানী-_ অর্থাৎ ঠিকে আয়ারা রোদে বসে ক্রুশ বুনছে আর মাঝে 
মাঝে ধমক দিচ্ছে বাচ্চাদের | স্বাস্থ্যান্বেষী বড়রা এখনো বেড়িয়ে 
ফেরে নি-_ছু-চারজন মাত্র ঘুরছে এদিক ওদিক। তাদেরই একজন 
পুর্ণোৎসাহে বাচ্চাদের সঙ্গে মেতেছে একটা রবারের বল নিয়ে । 


৯৪ 


বছর কুড়ি বাইশের ছোকর1। মাথায় জকি ধরনের টুপি, গায়ে 
লেদার জ্যাকেট । কলকাতার কোন্‌ বিখ্যাত প্রসাধন প্রতিষ্ঠানের 
বংশধর । 
কিন্ত হঠাৎ বাচ্চাদের সঙ্গে কেন? এর জায়গা তো এটা 
নয়। ছোকরার একট বিশেষ দুর্বলতা আছে এবং সে ছুর্বলতার 
খবর সকলেরই জানা । দাজিলিডে এলে প্রেমে পড়বার সুযোগ 
মেলে এমনি একটা ধারণা নিয়ে এসেছে । তাই পাস্থ-নিবাসের 
প্রতিটি মেয়ের পেছনেই ছুটে বেড়ায়। কিস্তু তোতলামি আর 
ক্যাবলামির জন্যে কেউ ওকে আমল দেয় না--এমন কি করুণাময়ী 
মিস্‌ রায়ও নয় । 
তাই কি মনের ছুঃখে বাচ্চাদের দলে ভিড়ল ? কিন্ত এখানেও 
সুবিধে হবে নাআমি মনে মনে ভাবলাম । আট বছরের হনুমান 
দাস কাছাকাছি কোথাও নেই--একবার এসে পৌছুলে সেই-ই 
ওকে “নকৃ আউট”? করে দেবে ! 
“তোমারে পাছে সহজে বুঝি, তাই কি এত লীলার ছল, 
বাহিরে যবে হাসির ছটা-__” 
চিবোনেো মেয়েলী গলায় আবৃত্তি । না, ছেলেটা হিসেবে 
ভুল করে নি। লনের ভেতরে যে ছত্রাকার বসবার জায়গাটি 
আছে, সেখানে তিন-চারটি মেয়ের আসর বসেছে । অসমাপ্ত 
কবিতাটিকে ঢেকে দিয়ে খিল্খিল্‌ হাসির আওয়াজ ভেসে এল 
ওখান থেকে । 
দ্বিগুণ বেড়ে উঠল ছোকরার উৎসাহ । 
এইবার ব-বল আমাকে দ--দাও। আমি গ--গঁ গোল 
দ্‌__দিচ্ছি-_ 
মিস্টার চাকলাদারের সঙ্গে গিয়ে ভেড়ে না কেন? একটা 
অযাচিত উপদেশ দেবার আগ্রহ জাগল ওকে । 
আবার ম্যাকামিভরা আবৃত্তি কানে আসছে £ 
“বুঝি গো আমি বুঝি গে। তব ছলনা 
যে কথা তুমি বলিতে চাও-_সে কথা তুমি বল না” 


৯%& 


ছোক্ষব্াকেই শোনাচ্ছে নাকি? কে জানে--আদার ব্যাঁপারী 
হয়ে জাহাজী খবরে মাথা না ঘামানোই ভালো । 

লাউপ্রের দিকে পা বাড়াই। কিন্তু সেখানে বসে নরোত্তম- 
বাবু। আমাকে দেখে ভ্রকুটি হানলেন। 

আসুন, আসুন--বসুন । 

মুখে পাকা গোঁফ, মাথায় পাকা চুল। ষাটের ওপরে বয়স । 
বেশ ভারী চেহারা । ব্রাড্‌-প্রেশারের রোগী বলে বেশি চলা-ফেরা 
করেন না প্রায়ই পাজামার ওপরে একটা গাউন চাপিয়ে বসে 
থাকেন চুপচাপ । 

আমি বসতেই কড়া গলায় জানতে চাইলেন £ ওপরতলার 
অসিত দত্ত লোকট! কে, বলুন তো ? 

শুনেছি, কোথাকার জমিদার । অনেক টাকার মালিক। 

টাকার মালিক! জমিদার! নরোত্তমবাবু আবার ভ্রকুটি 
করলেন £ আমিও এক সময়ে এস্ পি ছিলাম পুলিসে। অনেক 
জমিদারের ভিটেয় ঘুঘু নাচিয়েছি__-জানেন ? 

জাঁনতাঁম না, কারণ আমি জমিদার নই। সংক্ষেপে জিজ্ঞাসা 
করলাম £ এত চটছেন কেন ? 

চটব না! ডেকে আলাপ করতে গেলাম, ভালে! করে একটা 
জবাব দিলে না পর্যস্ত ! ভারী আমার ইয়ে রে! দোতলায় থাকেন ! 
একটাকা বেশি দেবার ডাট্‌ কত ! 

সবাই হয়তো বেশি কথাবার্তা বলতে পারেন না। স্বল্পভাষী 
অনেকেই থাকেন। 

রেখে দিন স্বল্পভাষী | বত্রিশটি বছর পুলিসে চাকরি করেছি__ 
বুঝলেন? কোন্টা স্বভাব আর কোন্টা ডট সে আমাদের 
বিলক্ষণ জানা আছে। অমন অনেক জমিদারকে ধরে আমি ধোলাই 
দিয়েছি-_-মনে রাখবেন। 

চটবেন না নরোত্বমবাবুঃ আপনার তো ব্লাড, প্রেশার রয়েছে 
আবার ! 

বাড প্রেশারের নাম শুনে নরোত্তমবাবু দমে গেলেন £ চটতে 


গড 


কি আর চাই--চটিয়ে ছাড়ে! দে যাক, মরুক গে। ভালো 
কথা-_এখান থেকে টিবেটের ভিস্ট্যান্স কত বলুন তো? 
শ-খানেক মাইল হবে বোধ হয়--সিকিম পেরিয়ে তো যেতে 

হয়! কিন্ত হঠাৎ তিববত গিয়ে কী করবেন ? 

ভাবছি এবার ওদিকেই ঘর-সংসার ছেড়ে পা বাঁড়ীব, একটা 
মঠেফঠে লাম। হয়ে বসব গিয়ে! আর মায়ার বন্ধন নয় মশাই। 
দাজিলিঙে আসবার পর থেকেই মনটা কেমন উদাস হয়ে গেছে। 
ভূতপূর্ব পুলিস সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । 

এই গোল্ড স্টোনের মালাটায় আপনাকে চমতকার মানাবে, 
আর আপনার আংটির জন্যে ওই ক্যাটস আই। 

স্তাবক-পরিবৃতা মিস্‌ রায় ফিরছেন মার্কেটিং সেরে। প্রেমিক 
ছোকর1 বল খেল! ভুলে গিয়ে করণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে 
রইল জুলজুল করে। তার লাল শাড়ি আর লাল কোট যেন 
ছোকরার বুকের রক্তে রাডানো। 

নরোত্তমবাবু দাত বের করে ভেংচি কাটলেন £ ওই এলেন ! 
লক্ষ্মীছাড়া-_বখাঁটে মেয়ে! আমি এখন পুলিসে থাকলে ওই 
মেয়েটাকে বি-এল্‌ কেসে ঠকে দ্িতাম-_বুঝলেন । 

দাড়িয়ে পড়ে বললাম, চলি নরোত্তমবাবুঃ সান করতে হবে । 


দুপুরে ডাইনিং হলে খাগ্নীতি, রাজনীতির ব্যাখ্যা । ভিটামিনের 
গুণাগুণ বিচার । দাজিলিং সিমলা আর শিলঙের তুলনামূলক 
আলোচনা । মুন্ন,লাল আর হনুমান দাসের ভেতর রুটি ছোড়াছুড়ি । 
ঘরে এসে একটা চিঠি লেখবার চেষ্ট। করলাম, কিন্তু কিছুতেই 
মন বসানো যাচ্ছে না। পাশের ঘরের মহিলাটি ক্রমাগত তীক্ষস্বরে 
চেঁচিয়ে চলেছেন £ এই নানী, বাচ্চাকে। তোয়ালে ধুয়ে দাও-_ 
গরম পানি লাও-_ 
উঠে পেছনের বারান্দায় গেলাম, কিন্তু সেখানেও সুবিধে হল না। 
নেই পাঞ্জাবী মেয়ে আর মারাঠী ছোকর1 । সার! দিনই এখানে আছে 
নাকি এরা ? প্রেমের অমৃত পান করে নাওয়া-খাওয়। ভূলে গেছে? 
নি পু 


আবার ঘরে ফিরলাম, এবং সঙ্গে সঙ্গেই খাতা হাতে কাঞ্চনের 
প্রবেশ । 
দাদা, ছুটো একটা কবিতা শোনাতে চাই-_মুখে তার সেই 
আধ্যাত্মিক হাসি। 
কতবার আর ব্যথা দেওয়া যায় বেচারীকে ? বললাম, পড়ো, 
শোনা যাক। 
কাঞ্চন জুত করে বসে আরম্ভ করল £ 
“হে হিমাদ্রি, বিচিত্র বিশাল, 
তোমার রহস্ত ভাবি চিত্তে মোর বিস্ময়ের জাল 
ছড়ায় কুহেলি সম । মনে হয় যুগ-যুগাস্তর-_ 
স্তব্ধ তৃমি, মৌন তুমি ধ্যানমগ্ন তাপস প্রবর-_, 
খানিকক্ষণ পরে চটকা ভাঙল কাঞ্চনের ক্ষু্ন অভিযোগে । 
দাদ! ঘুয়ুচ্ছেন বুঝি? তা হলে এখন বরং থাঁক-_- 
লজ্জিত বোধ করলাম £ এমনি একটু ঝিম ধরেছিল, কিছু 
মনে করো না। তুমি পড়ে যাও । 
কাঞ্চম আবার খাতা! খুলতে যাচ্ছিল, কিন্ত তার আগেই লন 
থেকে বিকট হৈহৈ চিৎকার উঠল। যেন ইস্টবেঙ্গল আর 
মোহনবাগানের খেলায় গোল হয়েছে! ছু'জনেই বারান্দায় 
বেরুলাম । 
লনে মস্ত একটা গ্রুপ, ফোটা তোলা হচ্ছে। তুলছেন 
বিখ্যাত রসিক মিস্টার ঈকলাদার। কী মন্ত্রে তিনিই জানেন-_ 
পান্থ-নিবাসের প্রায় সব কটি তরুণীকেই সংগ্রহ করেছেন তিনি । 
সকলের মাবখানে মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়েছেন মিস্‌ রায়, তাঁর 
পরনে এখন কালে ভয়েলের শাড়ি, গায়ে কালে ওভারকোট । 
কিন্ত ক্যামেরা বসানো আর ঠিক হচ্ছে না। একবার সামনে 
এগোচ্ছেন আর একবার পিছিয়ে যাচ্ছেন চাকলাদার । সরস 
মন্তব্য চলছে সঙ্গে সঙ্গে । 
এই যে মিস্‌ ঘোষ, আপনার মাথাটাকে কিছুতেই ম্যানেজ 
করতে পারছি না। দেখুন সুলতা দেবী, অমন করে হাসবেন 


৮ 


না। ক্যামেরাম্যান নার্ভাস হয়ে গেলে পেত্বীর মতো ফটে। উঠবে 
আপনাদের--মনে থাকে যেন ! 

চারদিকে তরুণের দল সমস্বরে জয়ধ্বনি তুলছে। হনুমান 
দাস অকারণ পুলকে একটা ডিগ্বাজি খেল। পাঞ্জাবী মেয়েটি 
গ্রুপের মধ্যে দাড়ায় নি-_বিষঞ্ন গম্ভীর চোখ মেলে তাকিয়ে আছে 
অনুষ্ঠানটার দিকে । প্রেমিক তোত্‌্লা ছেলেটিও একটা ক্যামেরা 
কাধে চোরের মতো! ঘৃর্ঘুর করছে--চান্দ পেলে সেও একটা 
ছবি নেবে! 

কাঞ্চন কবিতার রসভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় একটু চটেই ছিল-_ 
তার ওপর মেজাজেও একটু পিউরিটান। বিরক্ত গলায় বললে, 
দেখছেন, কেমন বিশ্রী হুল্লোড় করছে! 

হুল্লোড় মানে? দস্ভতরমতো বেলেল্লাগিরি--পাশ থেকে নযোত্বম- 
বাবু বিকট কণ্ঠে বললেনঃ ছিঃ-_ছিঃ__একটা ভব্যতাও তো 
আছে! দিনের পর দিন এসব কী হচ্ছে মশাই-_ চোখে দেখ! 
যায় না যে! 

কিন্ত চোখে দেখা না গেলেও দেখার লোভটা সামলাতে 
পারেন নি নরোত্তমবাবু। বিষাক্ত দৃষ্টিতে পুলিসী ক্রোধের জ্বাল। 
ছড়িয়ে হয়তো! ভাবছেন, এদের নামে একটা বি-এল কেস করা 
যায় কিনা। 

চাঁকলাদার ঠেঁচিয়ে উঠলেন ₹ ওয়ান-_-টু-উছ হল না! 
আই জ্যাম সরি মিস্‌ নন্দী__ আপনি এক্ষুনি বেল! দেবীর পিঠে একটা 
চিমটি কাটলেন ! 

আর ও যে আমাকে-_ 

“আয়েগা আয়েগা আনেবালে' মুন্ুূলাল গান ধরলে আচমকা । 

ইউ ব্র্যাট, শা আপ. ! হুংকার ছাড়লেন চাকলাদার । হাসির 
দমকে একেবারে বেতসকুঞ্জের মতো নুয়ে পড়লেন মেয়েরা । ছেলেদের 
ভেতর থেকে একটা দানবীয় কোলাহল উঠল ! 

ওফ.-_নরোত্তমবাবু আর্তনাদ করলেন। 

ব্লাডপ্রেশার আছে ভদ্রলোকের, একট! কেলেক্কারী ন! হয়ে যায়! 


2৪ 


কাঞ্চন বললে, চলুন দাদ ঘরে চলুন-_য্ত সব ছ্যাব লামি ! 
ঘরেই ফিরলাম। কাঞ্চন আবার কবিতার খাতা খুলল £ 
“কালকে রাতে ঘুম-পাহাড়ের হাজার তারা-_ 
হিমের আড়ে ঘুমিয়ে গেল আপন হার! । 
আমি কবি, একলা! বসে বাতায়নে, 
কিন্তু এবারেও সুর কাটল । 
আর-একটা প্রচণ্ড কোলাহল । একবারের জন্তে ভেসে উঠেই 
স্তব্ধ হয়ে গেল আকস্মিকভাবে । একটা মৃত্যুর গভীরতায় তলিয়ে 
গেল পাস্থ-নিবাস ৷ 
আবার বেরিয়ে এলাম । 
লনের সমস্ত মানুষগ্ডলো যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে। ক্যামেরা 
হাতে রদিক চাকলাদার বোকার মতো দীভ়িয়ে। মেয়েরা দল 
ভেঙে নিঃশব্দে সরে যাচ্ছে এদিকে ওদিকে । হনুমান দাস আর 
মুনুূলাল গা ঘেষে দাড়িয়ে আছে সভয়ে । পাঞ্জাবী মেয়েটির দৃষ্টি 
উদ্ভ্রান্ত । যারা এতক্ষণ কোলাহলে চারদিক কাপিয়ে তুলছিল-_- 
তাবা কথা কইছে নিঃশব্দ সন্ত্রস্ত কণ্ঠে। প্রেমিক ছেলেটি যেন 
পালাবার পথ খুঁজছে । ওপর তলার অসিত দত্ত কখন নরোত্বম- 
বাবুর কাছে নেমে এসে পাশাপাশি নিথর হয়ে গেছেন । 
পাশের ঘরের নেপালী “নানী” নিজের সাত মাসের বাচ্চা ফেলে 
দৈনিক একট। টাকার লোভে পরের ছেলের ভার নিতে এসেছিল । 
গরীব মা তার লোভের শাস্তি পেয়েছে । এই মাত্র খবর এল, পাহাড় 
থেকে গড়িয়ে পড়ে মার গেছে তার সাত মাসের বাচ্চাটা । 
আকাশে একখানা কালো মেঘ উঠছে-_পাস্থ-নিবাসের সব 
কিছু বেসুরো। হয়ে গেছে মুহুর্তের মধ্যে। কিন্তু একটু পরেই 
মেঘ কেটে গেলে- রোদে ঝল্মল্‌ করে উঠবে সাড়ে ছ-হাজার 
ফিটেরও অনেক--অনেক ওপরে শহর দাজিলিং। সেই ফাকে 
ক্যামেরাটা আর একবার লোড করে নিন মিস্টার চাকলাদার, 
আর একবার শাড়ি আর কোট বদলে নিতে পারেন মিস. রায় । 


১৪৩ 


ক্ষত. 

পাবলিক লাইব্রেরি থেকে আনা "পাতা মুড়িবেন না” ছাপ মারা 
এবং পাতায় পাতায় মোড়া জীর্ণ বালা উপন্যাসখানা পড়বার চেষ্টা 
করছিল সিতাংশু। রাত এগারটার কাছাকাছি, অসহা গরম। 
জানল। দিয়ে বাতাস আসছিল না, তা নয়, কিন্তু তাতে আগুনের 
ছোয়া । দিনে ছূর্দাস্ত গরম থাকলেও সন্ধ্যার পরেই নাকি সীাওতাল 
পরগনার স্ুুশীতল বাতাস বইতে থাকে, এমনি একটা জনশ্রুতি 
তার শোন! ছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, রাত 
তিনটের আগে সেই বিখ্যাত প্ণীতল হাওয়াটি” প্রবাহিত হওয়ার 
€কোনও সম্ভাবনা নেই। 

বইটি প্রেমের উপন্যাস এবং শুরু হয়েছে পাইন বনের ভিতরে 
একটি আকাবাক পথের উপর $ কুয়াশা! কেটে গিয়ে পাইনের 
উধ্বমুখী কণ্টকপত্রে সোনালী রোদ পড়েছে ছু'ধারে বরাশ ফুল 
ফুটেছে রাশি রাশি, আর ওভারকোটের পকেটে হাত দিয়ে একটি 
মেয়ে আশ্চর্য গভীর চোখ মেলে দূরের নীল পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে 
আছে। ঠিক সেই সময়-_ 

ঠিক সেই সময়েই বিরক্ত হয়ে সিতাংশু পর পর কয়েকটা পাতা 
উল্টে গেল। এই ছৃধর্ধ গরম, ইলেক্‌টট্রকবিহীন এই বাড়ি, নিঃসঙ্গ 
এই জীবন--এর ভিতরে শীতল পাহাড়ের কবোঞ্চ রোমান্স তার 
কল্পকামন। অনেকটা মেটাতে পারত; কিন্ত সিতাংশুর প্রতিক্রিয়! 
অন্যরকম হল। কেন এমন বাজে বই লেখ! হয়, কেই ব৷ সেটা 
ছাপে এবং যদ্দিই বা সেটা ছাপা! হয়, তা হলে পাতাগুলে। দিয়ে মুড়ির 
ঠোঙ। তৈরি না করে পাঠককে যন্ত্রণা দেবার জন্তে লাইব্রেরিতে 
রাখা হয় কেন, এই ধরনের গোটাকয়েক আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা তার 
মনের ভিতর দ্বুরপাক খেয়ে গেল। 

কিন্ত লাইব্রেরির বইয়ের আরও একটা আকর্ষণ আছে। সে 


১৬৬ 


হল অনাহ্ুত টীকাঁকারদের মন্তব্য । বাঁধাইয়ের ছু'ধারের শাদ! 
পাতায়, বইয়ের মাজিনে রসিক পাঠকদের নানা রকম স্বতোতসারিত 
উচ্ছ্বাস । যেমন £ “বাঞ। বেশ বেশ--একেই বলে খাঁটি প্রেম” 
“একসেল্গেন্ট' কিংবা “মণিকার এইরূপে চিন্তা করা অন্যায়। হিন্দু 
নারী হইয়া সে পরপুরুষের” ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়া কীচ। 
হাতের কিছু কিছু অক্লীল মস্তব্যও থাঁকে। আর বই যদি পাঠকের 
ভালো না লাগে, তা হলে লেখকের উদ্দেশে যে-সব মন্তব্য বর্ণ করা 
হয়, ভদ্রলোক সেগুলো জানতে পারেন না বলেই আত্মহত্যা 
করেন না । 

অতএব মিতাংশুও কালিদাস ছেড়ে মল্লিনাথ পড়া শুরু করল। 
একটি নয়-_অস্তত পেন্সিলে আর কালির লেখা গুটিসাতেক মক্লি- 
নাথের সন্ধান পাওয়া গেল। কাছাকাছি কোনও হ্যাও রাইটিং 
এক্সপার্ট থাকলে সঠিক সংখ্যাটা বলতে পাঁরতেন। 

কিন্তু তাই বা ভালে লাগে কতক্ষণ । গরম- কদর্য গরম। 
হাওয়াটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে । জানলার বাইরে কালে। ব্রোকেডের 
পদর্ণর মতো টান! অন্ধকার-_-তার ভিতর দিয়ে ছু-তিনটে ইউক্যালি- 
পটাসের বাঁকলহীন শ্তত্রতা অতিকায় ক্কালের মতে! দীড়িয়ে । মিউ- 
নিসিপ্যালিটির একটা কেরোসিনের আলে! জানলার প্রায় মুখোমুখি 
ছিল, সেটা সন্ধ্যে না লাগতেই নিবে গিয়েছে । ঘরের দেওয়ালে 
লগ্টনের আলোয় নিজের যে ছায়াটা পড়েছে-_সেটাকে পর্যস্ত 
সিতাংশুর অসহ্য বোধ হতে লাগল । ওটা যেন তার মনের ছায়া__ 
বিকৃত, অর্থহীন, অশোভন, অশালীন; বাইরের অন্ধকারে গিয়ে 
ওটা দাড়ালেই ভালে! হত-_তাঁর প্রত্যেকটা! অঙ্গভঙ্গিকে এমনভাবে 
ক্যারিকেচার করবার প্রয়োজন ছিল না। 

ঘাম ঝরছে নাঁ_সারা শরীর যেন জ্বালা করছে। একবার 
ন্নান করতে পারলে ভালো হত। কিস্ত-_ 

ঠিক নাটকীয়ভাবে সেই সময় শব্দটা শুনল সিতাংশু। পরিক্ষার 
শুনতে পেল। ইদারার গায়ে-দড়ি ঘষার খদ্খস্‌ আওয়াজ, বাশের 
একটা মৃছ গোঙানি আর ছলাত ছলাত করে জলের কলধ্বনি। 


১৬ 


সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল সিতাংশু। লঙঞ্ঠনটা কমিয়ে দিয়ে পা টিপে 
টিপে দরজার কাছে এসে দাড়ালো । তার পর কপাটট। ইঞ্চি তিনেক 
ফাঁক করে তীক্ষদৃষ্টি মেলে দিলে সামনের দিকে । 

বাড়ি যতই ছোট হক--তারের বেড়া ঘেরা কম্পাউগ্তডাট। 
অনেকখানি । দিতাংশুর ঘর থেকে প্রায় চল্লিশ গজ দূরে তার 
ইদারা। এই অন্ধকারে একটা ঝাকড়া পিপুল গাছ আরও 
অন্ধকার ছড়িয়েছে তার উপর। তবু স্পষ্ট দেখলে সিতাংশু। 
কে একজন ইদার। থেকে জল তুলছে-_বালতি উপরে টানার 
সঙ্গে সঙ্গে তার নুয়ে-পড়া শরীরটা সোজ। হয়ে উঠছে আস্তে 
আস্তে । 

হিংঅ্র ক্রোধে দীতে দাত চাঁপল সিতাংশ। এই ব্যাপার! 
এই জন্যেই অতখানি টলটলে জল ছু" দিনের ভিতরেই বালিতে 
ভরে উঠছে! সন্দেহ একটু ছিলই--এইবার বোঝা গেল সব। 
জল চুরি হচ্ছে। 

একট বিশ্রী উপন্যাস। কুৎসিত গরম। নিঃসঙ্গ নির্বাসিতের 
মতো! জীবন । ইলেক্টিকের আলোহীন ঘরে নিজের ছায়ার 
ভ্যাংচাঁনি। তাঁর উপর টুরি? সিতাংশুর মাথায় আগুন জ্বলল। 

দরজা বন্ধ করে সে ঘরে ফিরে এল । কীকরা যায়? তাড়া 
করলে তারের বেড়া ডিঙিয়ে পালাবে ।--ধর। যাবে না । অসম্ভব 
আশায় চারদিকে একবার সে তাকিয়ে দেখল--কোনও মির্যাকলে 
একট বন্দুক যদি এই মুহুর্তে হাতের কাছে পাওয়া যায়, তাহলে 
আর ভাবনার কিছু থাকে না। কিন্তু বন্দুকের বদলে পাওয়! 
গেল একটা মশারির স্ট্যাণ্ড। 

আর দেরি করা যায় না। জলের বালতি নিয়ে একবার 
তারের বেড়া টপকে চলে গেলে আইনত সিতাংশুর আর কিছুই 
বলবার নেই। সুতরাং যা করতে হয়-_এক্ষুনি | 

মশারির স্ট্যাণ্ডটা শক্ত করে ধরে পিছন দিয়ে ঘুরে সিতাংশ 
ইদারার দিকে এগোতে চেষ্টা করল। চোর তখন নিবিষ্টচিত্তে 
জল তুলছে । জলের ছলাত ছলাত আওয়াজ সিতাংশুর ভ্বালাধর! 


১৩৩১ 


রোমকৃপঞ্ুলোকে পুড়িয়ে দিতে লাগল । তার পর ধখন আর 
এগনেো চলে না-যখন প্রায় দশন্বার গজের মধ্যে এসে পড়েছে 
যখন অর এক পা! বাড়ালেই চোর তাকে দেখতে পাবে, তখন 
হাতের ডাগাটা সে ছুড়ে মারল সবেগে। 

নিভূ'ল লক্ষ্যভেদ ! একটা মুছ আর্তনাদ করে চোর মাটিতে 
ঘুরে পড়ল। 

কিন্তু সিতাংশুর হাত-পা জমে গিয়েছে তৎক্ষণাৎ । গরম, বিরক্তি 
আর ক্রোধে অতখানি অন্ধ না হলে আরও আগেই সে বুঝতে 
পারত। একটি মেয়ে। 

কী সর্বনাশ ! রোম্যান্টিক উপন্যাসের পাতা থেকে একেবারে 
নারীহত্যায় ! 

কে বলে, পশ্চিমের গরমে ঘাম হয় না? মুহূর্তে ঘেমে উঠল 
সিতাংশু, ভিজে গেল গেশ্রি, জিভট1 চলে যেতে চাইল গলার 
ভিতর, মাথাটা! একেবারে ফাপা হয়ে গেল। এইবার ? 

মেয়েটা! নড়ে উঠল। উঠে বসতে চেষ্টা করছে । যাক-_- 
একেবারে খুন হয়নি তা হলে, বেঁচে আছে এখনও ! সস্তর্পণে 
কাছে এগোল সিতাংশু । 

এক টুকরো টাদ উকি দিয়েছে আকাশে । পিপুল গাছের 
পাতার ভিতর দ্দিরে শ্লান খানিকটা আলে এসে পড়েছে মেয়েটির 
মুখে । চিনতে পেরেছে সিতাংশু। পিছনের বাড়িতে পোস্ট অফিসের 
যে নতুন ভদ্রলোৌকটি এসেছেন-__ভারই কেউ হবে। ভদ্রলোকের 
সঙ্গে আলাপ হয় নি-_কিস্ত মেয়েটিকে কয়েকদিনই চোখে পড়েছে। 

সিতাংশু সামনে আসতে টলতে টলতে উঠে ফাড়ালো । চাদের 
আলোতেও দেখ। গেল, তার কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। আর 
সেই সঙ্গে শোনা গেল ফোপানে কান্নার স্বর ঃ এক বালতি 
জল নিতে এসেছিলুম আপনার ইদারা থেকে, সেজন্যে এমন করে 
আমায় মারলেন! 

আগেই মরমে মরে গিয়েছিল সিতাংশু, এবার মিশে গেল 
মাটিতে । 


১৬৪ 


জল 


আমায় ক্ষম! করবেন । মানে, আমি হেন 

কী ভেবেছিলেন 1--কান্নার ভিতর থেকে এবার বঝাণীঝ বেরিয়ে 
এল, কোনও পুরুব-মানুষ ? যেই হোক না_-এক ফৌট। জলের 
জন্যে তাকে আপনি খুন করতে চাইবেন? আপনি ন1 ভদ্রলোক ? 

গলার স্বরে বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা খুব গুরুতর হয় নি। 
ভরসা পেয়ে রাগ হল সিভাংশুর। এক ফৌঁটা জলই বটে! 
এদিকৃকার সমস্ত ইদারাই প্রায় শুকিয়ে মরুভূমি-_-সিকি মাইল 
রাস্তা পেরিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির একট! টিউবওয়েল ভরসা । তার 
ইদারায় যে ছু-চার বালতি জল আছে, তা-ও এ-ভাবে লুট হতে 


'থাকলে মাথায় খুন চাপা অন্যায় নয়। 


কিন্তু সে-কথা। বলল না সিতাংশু। 

এসে চাইলেই পারতেন। 

চাইলেই যেন দিতেন আপনি । 

স্পষ্ট পরিষ্কার কথা। না-_দিত না সিতাংশু। এই ছুঃসময়ে 
অতখানি উদারতা তার নেই, কোনও মহিল! সম্পর্কেও না। 
বিব্রত হয়ে সিতাংশু বললে, থাক ও-সব কথা । আপনার কপালটা 


কেটে গিয়েছে মনে হচ্ছে । দাড়ান, আয়োডিন এনে দিচ্ছি। 


খুব হয়েছে, আর উপকার করতে হবে না। কপাল ফাটিয়ে 
দিয়ে জলের দাম তো আদায় করলেন। কী করব এখন? জলট! 
নিয়ে যাব; না আবার ঢেলে দেব ইদারায়? 

সিতাংশু অপ্রস্তত হল। আশ্চর্যও হল সেই সঙ্গে। একটুও 
আত্মসম্মীন নেই মেয়েটার__-এত কাণ্ডের পরেও ভুলতে পারে নি 
জলের কথাট। ! 

ছি,ছি, কী যেবলেন! চলুন, আমিই পৌঁছে দিয়ে আসছি 
জলটা-_- 

কোথা থেকে এসে পড়ল টর্টের আলো । চমকে তাকাল 
'ু'জনেই। 

পোস্ট অফিসের সেই ভদ্রলোক । পিছনের বাড়ির নতুন ভাড়াটে । 


৭ ১৬৫ 


কী হয়েছে বুলু ?+-টর্চের আলোয় বুলুর কপালের রক্ত 
একরাষী সিছরের মতে! ঝকঝক করে উঠল$ কী করেছিস 
বাগ ? 

সিতাংশু পাথর হয়ে গেল। আর বুলুই জবাব দিলে। 

অন্ধকারে ইদারার ওপর পড়ে গিয়েছিলুম কাকা । ইনি 
ছুটে এসে_ 

তারের বেড়া টপকে ভিতরে এলেন ভদ্রলোক । 

তোকে হাজারবার বারণ করলুম, এত রাতে জলের দরকার 
নেই, তবু হতভাগা মেয়ের কানে গেল না। তোর জন্যে শেষে 
একট কেলেঙ্কারিতে পড়ব এ আমি ঠিক জানি। নে চল্‌-_ 
বালতি তুলে নিয়ে ভদ্রলোক সিতাংশুর দিকে তাকালেন £ কিছু 
মনে করবেন না মশাই, এই মেয়েটার জ্বালায় আমার একদণ্ড 
স্বস্তি নেই। কপালে যে আমার কত ছুঃখ আছে সে কেবল 
আমিই জানি। আপনার ঘুম নষ্ট হল, অপরাধ নেবেন না। 

সিতাংশু কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু স্থঘোগ পেল না। বিহ্ব- 
লতার ঘোর কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই কাকা-ভাইঝি তারের 
বেড়া পার হয়ে চলে গিয়েছেন। ফিকে চাদের আলোয় ছুটে" 
অবাস্তব ছায়ামৃতি। 

কয়েক সেকেও্ড চুপ করে দীড়িয়ে থেকে নিচু হয়ে মশারির 
স্ট্যাগ্ুটা তুলে নিলে সিতাংশু। এটা কি চোখে পড়ে নি ভদ্র- 
লোকের ? নাঁপড়া অসম্ভব। অসহ্য গরম নিঃসঙ্গ ঘরটার দিকে 
যেতে যেতে সিতাংশু নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে চাইল, কে ভালো 
অভিনয় করেছে ? বুলু, না তার কাকা? 


সারাটা রাত আর ভালে। করে ঘুম এল না, কাটল অন্বস্তি- 
ভরা তন্দ্রার ভিতর। চোখ কচলাতে কচলাতে সিতাংশুড যখন 
বারান্দায় এসে দাড়ালো, তখন তীক্ষ উজ্জল রোদে চারদিক তরে 
উঠেছিল। রাস্তার ওপারে ইউক্যালিপটাসের সারি পেরিয়ে কাকর- 


১৬৩ 


মেশানো ঢেউ-খেলানো মাঠ তার ভিতয়ে একট! খাপছাড়া শাদা 
বাড়ি রোদে জলভ্ত হয়ে উঠেছে। দূরের রুক্ষ পাহাড়ট! পড়ে 
আছে অপরিচ্ছন্ন বন্ত মহিষের মতো---তার পত্রহীন গাছপালা আর 
বড় বড় স্যাড়া পাথর স্পষ্ট দেখ! যাচ্ছে এখান থেকেও । 

সব শ্রীহীন-__সবকিছু আগুন দিয়ে ঝলসানো । মেঘনা-পারের 
সিতাংশু বিরস বিতৃষ্ণ মুখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ভার পর মনে 
পড়ল, একদিনের ছুটি নিয়ে তার ছোকরা চাকর ধনিয়া নিজের 
“গাওমে' গিয়েছিল__-আজ চতুর্থ দিনেও সে ফেরে নি। গ্রামে যাওয়া 
খুবসম্ভব বাজে কথা--বেশি মাইনেতে আর কোথাও কাজে লেগেছে। 
ওর দোষ নেই। ভদ্রলোকেই যদি জল চুরি করতে পারে-_ 

মেঘনা-পারের সিতাংশু সেনগ্প্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাহার! 
মরুভূমি নয়-_-বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে একশো মাইলের 
মধ্যেই যে জল চুরি করবার দরকার হয়, মেঘনার কাঁলেো৷ অথই 
জলের দিকে তাকিয়ে সে কথা কে ভাবতে পারত ! 

কিস্তু ও-সব তত্বচিস্তা এখন থাক। আপাতত সিতাংশুকে 
নিজের হাতে চা করতে হবে, রান্নার ব্যবস্থা করে নিতে হবে। 
তবু তো আজ বাজারে যাওয়ার সমস্তা নেই--কাল অফিস থেকে 
ফেরবার সময় বুদ্ধি করে আলু আর ডিম নিয়ে এসেছিল। নাঃ, 
আর দেরি করা৷ চলে না। 

মুখ ধুতে ইদারার পাড়ে আসতেই চোখে পড়ল। তিন চার 
ফোটা রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। আত্মগ্লানিতে সিতাংশু 
সেদিকে আর তাকাতে পারল না। মেয়েটিকে একবার এক! 
পাওয়া দরকার, ভালে! করে ক্ষমা চাইতে হবে । হাঁটতে হাটতে 
একসময় যাবে নাকি ও-বাড়িতে ? কিন্তু আলাপ পরিচয়টাই 
বখন হয়ে ওঠে নি এ পর্যস্ত, তখন-_ 

অন্থমনস্কভাবে ইদারায় বালতি নামিয়েছিল, অন্যমনস্ক হয়েই 
টেনে তুলল । আর তৎক্ষণাৎ সমস্ত অনুতাপ মুছে গেল--প 
থেকে জলে উঠল মাথা পর্যস্ত। অর্ধেক জল, অর্ধেক বালি। 


১৪৭ 


আঁরও অর্ধেক শুকিয়ে দিয়েছে ইদারা, কাল ওভাবে চু্সি ন! 
হলে গজকের দিনটা কুলিয়ে যেত। চাকরট। থাকলেও বা কথ। 
ছিল, এখন তাকেই গিয়ে সিকি মাইল দুরের টিউবওয়েল থেকে 
জল আনতে হবে। আর যা ভিড় সেখানে ! 

হুত্তোর ! 

কাজোর জলে চ৷ খাওয়। কোনোরকমে চলতে পারে । স্নানের 
আশা নেই। অফিস যাওয়ার পথে খাওয়ার জন্যে ঢুকতে হবে 
হোটেলে । সিতাংশুর মনে হতে লাগল, মশারির স্ট্যাণ্ড দিয়ে 
ঘা! কয়েক ওই ভদ্রলোককেই বসিয়ে দেওয়! উচিত ছিল। সবই 
জানতেন_-অথচ কেমন ন্যাকামি করে গেলেন। আর মেয়েটা 
_সেই বুলু! অবশ্য রক্তপাত না হলেই খুশি হত সিতাশু; 
কিন্তু ভাণ্ডার ঘা তার যে একেবারেই পাওন। ছিল না, এই মুহুর্তে 
সে তা ভাবতে পারল না । 

অফিস থেকে বেরিয়ে, রাস্তায় চা খেয়ে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্য। 
হয়ে গেল। আবার সেই ঘর, সেই গরম, লঞ্টনের আলোয় 
নিজের কদাকার ছায়া আর সেই বাংলা উপন্তাসটা। লঞনট! 
জ্বালাতে জ্বালাতে মিতাংশুর মনে হল, তার পর আরও অনেক 
রাতে ইদারার থেকে আবার কেউ হয়ত জল চুরি করতে আসবে, 
যদিও আজ বালতি ভরে বালিই উঠবে কেবল। কিস্তুকে আসবে £ 
বুলু? না বুলু আর আসবে না। 

যদি বুলুই আসে? একটা অসম্ভব কল্পনায় রোমাঞ্চিত হয়ে 
উঠল সিতাংশু। তাহলে আজ কী করবে দিতাংশু? দূর থেকে 
দেখা, পিপুল-পাতায় জ্যোৎন্ায় আধখানা দেখা আর একটি ছোট 
টর্চের আলো এক ঝলক দেখা বুলুর মুখের সামনে আজ লগনট! 
তুলে ধরবে সে। দেখবে, কাল র্বাতে কতখানি ক্ষত সে মেয়েটির 
কপালে এঁকে দিতে পেয়েছে--কতট। লিখে দিতে পেরেছে নিজের 
ব্বাক্ষর । 

আসতে পারি ? 


৯৬৮ 


বুলু নয়-_তাপ্ কাকা। সেই অনেক রাতের প্রত্যাশিত লময়টির 
অনেক আগেই এসে পড়েছেন তিনি । 

সিতাংশু চমকে মাথা তুলে বললে, আন্মুন। 

বুলুকে লঠঠনের আলোয় দেখতে চেয়েছিল সিতাংশু, দেখল 
তার কাকাকে। বছর পয়তাল্িশেক বয়স হবে। শক্ত ভারী 
গোছের বেঁটে মানুষ। কপাল থেকে মাথার আধখানা পর্যস্ত 
মন্থণ টাক। সিতাংশুর জারুল কাঠের চেয়ারটায় সশব্দে আসন 
নিলেন। 

আলাপ করতে এলুম। আমার নাম বিরাজমোহন মল্লিক। 
আপনি ? 

সিতাংশু সেনগ্প্ত। 

দেশ ? 

সিতাংশুকে বলতে হল । 

তাই বলুন--আমাদের ইস্ট বেঙ্গলের লোক। চেহার। দেখে 
আমারও তাই মনে হয়েছিল । 

পূর্ববঙ্গত্ব এমনভাবে তার শরীরে লেখা আছে, এ-খবরটা 
এতদিন সিতাংশুর জান! ছিল না। মৃহ্‌ রেখায় হাসল সে। 

তা একা আছেন এখানে ? ফ্যামিলি কোথায় ? 

মা-বাবা কলকাতায় থাকেন। 

ওয়াইফ ? 

বাঙালির স্ত্রীকে বাংলা ভাষায় ওয়াইফ বললে ভারী কুণ্রী 
শোনায় সিতাংশুর কানে । তবু এবারেও সে অল্প একটু হাসল। 
বললে, তাঁকে এখনও জোটাতে পারি নি। 

বলেন কী, ব্যাচেলার ।-_বিরাজবাবু বিস্মিত হলেন £ তিরিশ 
তে। পেরিয়ে গেছেন বোধ হয়। 

হ্যা, বছর ছুই হল । 

তবু এখনও বিয়ে করেন নি! বুড়ো বয়সে যে ছেলের রোজ- 
গার খেয়ে যেতে পারবেন না! 


সে ঘৃশ্িন্তা় পিতাংশুর রাতে ঘুম হচ্ছিল না? তবু এবারে 
ভগ্রতার হাসি হাসতে হল। 

বাঝা-মা-ই বা কী বলে চুপ করে আছেন। বিরাজবাবু 
খ্বগতোঁক্তি করলেন, বিমর্ষভাবে চুপ করে রইলেন কয়েক সেকেগু । 
তার পর এলেন অন্য প্রসঙ্গে £ 

কিন্ত এই জলের কষ্ট তে। আর সহ্য হয় না৷ মশাই । মরুভূমিতে 
এলুম নাকি? 

সেরকমই তো মনে হচ্ছে । 

মিউনিসিপ্যালিটিতে কড়া করে একখানা দরখাস্ত দিলে 
কেমন হয় ? 

আসছে বছর গ্রীষ্মকালে সেন্দরখাস্ত নিয়ে ওরা আলোচনা 
করবেন। 

যা বলেছেন! সক্ষোভে বিরাজবাবু মাথা! নাড়লেন £ স্বাধী- 
নতার পরেও এর। যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেল। এ" 
দেশের উন্নতি হতে মশাই আরও পাঁচ শে! বছর । 

তার পর আধঘপ্টার মতো নির্বাক শ্রোতার ভূমিকায় নিঃশব্দে 
বসে রইল সিতাংশড। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা! যা বলবার থাকে, 
বিরাজবাবু কিছুই তার বাদ দিলেন না । গোটা তিনেক সিগারেট 
খেলেন এবং সামনে আ্যাশ৩ট্রে থাকতেও ছাই ঝাড়লেন মেঝের 
উপর। আর সিতাংশু কালকের মতে। নিজের ছায়া! দেখতে লাগল 
লনের আলোয়, কান পেতে শুনতে লাগল বাইরে মাঠের ভিতর 
দিয়ে হছুহু করে বয়ে যাচ্ছে হাওয়া, আর ইউক্যালিপ টাসের 
পাতাগুলে! ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে ভাতে । 

শেষ পর্যস্ত বিরাজবাবু উঠলেন । 

একটা লোকই তা হলে রাখ! যাক, কী বলেন? হু-বেলা 
টিউবওয়েল থেকে আমাদের ছু-বাসায় জল দেবে । টাকাটা দেওয়। 
যাবে ভাগাভাগি করে । 

সেতো বেশ কথা! 


১৩ 


দেখি তবে চেষ্টা করে- দরজার দিকে পা বাড়িয়েছেন বিরাজ- 
বাবু, সেই মুহুর্তেই প্রায় মুখ ফস্‌কে প্রশ্নটা! বেরিয়ে এল সিতাংগুর | 

আপনার ভাইবি কাল পড়ে গিয়েছিলেন--কেমন আছেন 
আজ? 

অদ্ভুত দৃষ্টিতে বিরাজবাবু সিভাংশুর দিকে তাকালেন। লঠনের 
আলোয় মেক-আপ কর। অভিনেতার মতো দেখাল তাকে । 

কে, বুলু? বুলু ঠিক আছে। সাংঘাতিক মেয়ে মশাই- অল্পে 
ওর কিছু হয় না। মাটিতে পুতে দিলে কাটাগাছ হয়ে বেরুবে । 

বিরাজবাবু বেরিয়ে গেলেন । 

আজও রাত বারোটা পর্ধস্ত একা ঘরে ছটফট করল সিতাংশু, 
সেই বাংল! উপন্যাসখানার পাতা ওল্টাল, রসিক পাঠকদের টাকা- 
টিপ্লনীগুলো পড়বার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্ত আজ আর 
অক্ষম বিরক্তিতে নয়--সেই অসম্ভব ছুরাশায় সে কান পেতে 
বসে রইল। কয়েকবার উঠে গেল জ্যোৎ্স্ার জাফরিকাটা পিপুল 
গাছটার তলায়। বুলু আজ আর আসবে না সে জানে, তবু এই 
রাত, এই গরম--আর উত্তেজিত স্নায়ুর একট বিচিত্র কুহকে 
সিতাংশু রাত আড়াইটে পর্বস্ত প্রতীক্ষায় জেগে রইল । তার পর 
বাতাস ঠাণ্ড। হয়ে এল, ক্লাস্ত অবসাদে ঝিমিয়ে এল শরীর, আর 
ঘুমের ঘোরে সিতাংশু স্বপ্র দেখল, মেঘনার কালো জলের উপর 
দিয়ে গেরিমাটির বন্যা! ছুটে চলেছে । 


বুলু এল না। 

সে রাতে নয়, ভার পরের রাতে নয়, তার পরের রাতেও 
নয়। সিতাংশু কেমন একটা ছুর্ধোধ্য যন্ত্রণায় পীড়িত হতে লাগল । 
আশ্র্যভাবে লুকিয়ে গিয়েছে মেয়েটা । যখন তাকে দেখার কোনও 
কৌতৃহল ছিল না, তখন কতবার পিছনের বাড়ির বারান্দায় 
খোলা জমিটুকৃতে কতভাবে তাকে সে দেখেছে । সেদিন সে বুলুকে 
মনে রাখতে চেষ্টা করে নি- দরকারও ছিল না । সেই আধ-খান! 


১১৯ 


দেখা, ঝিলিমিলি জ্যোতন্সায় একটুকরো দেখা আর ।বগাজবানুর 
উর্চের আলোয় রক্তের সি'ছুর-মাখানো একটুখানি শুভ ললাট, এর 
বেশি গার কিছু মনে আনতে পারে না সিতাংশু | সে শুধু একবার 
দিনের মালোয় দেখতে চায় বুলুকে- দেখতে চায় তার কপালে-_ 

দেখা হয় বিরাজবাবুর সঙ্গে । বাজারে, অফিসের পথে । 

জল পাচ্ছেন ঠিকমতো! ? 

পাচ্ছি। 

জন্টি মাস পার হয়ে গেল মশাই, এখনও বৃষ্টি নেই এক 
ফৌঁটা। কী করা যায় বলুন তো৷। 

কী আর করা যেতে পারে । আকাশের উদ্দেশে বৃষ্টির জন্মে 
একখানা দরখাস্ত লেখ। যেতে পারে- এমনি একটা জবাব আসে 
ঠোঁটের কোনায় । কিন্তু বিরাজবাবুকে সত্যিই ও-কথা৷ বলা যায় ন1। 

আর জিজ্ঞাসা করা যায় না বুলুর কথা। খবরের কাগজ 
চাইবার কিংবা বাড়িতে ভিক্সনারি আছে কিন! জানবার যে-কোনও 
একটা উপলক্ষ নিয়ে বিরাজবাবুর বাসায় একবার যে যাওয়া 
যায় না তাও নয়। কিন্তু কিছুতেই পেরে ওঠে না সিতাংশু। 
নিজের এই ছেলেমান্ুষি কৌতৃহলের উগ্রতা তাকে যত বেশি 
গীড়ন করে, ততখানিই লজ্জ! দেয় । 

কেন যে বুলুর ক্ষতচিহ্িত কপাঁলটাকে একবার দেখবার জন্যে 
এই পাগলামি তাকে পেয়ে বসেছে, সিতাংশু নিজের কাছেই তার 
কোনও কৈফিয়ত খুজে পায় না। বুলুর কাছে ক্ষমা চাইবে 
একবার ? বলবে, আমাকে যত বড় পাষণ্ড ভেবেছেন আমি তা 
নই? কোনও মেয়ের গায়ে হাত তোলা দুরে থাক, ছেলেবেলার 
সীমা পার হয়ে নিজের ছোট-ভাইকে পর্বস্ত কোনদিন একট চড়- 
চাপড়ও মারি নি? আর বুনুর কপালের দিকে তাকিয়ে নিজের 
অপরাধের সে পরিমাপ করতে চায়, জেনে নিতে চায়, কোনও 
বড় ক্ষতি সে করে নি, ছোট্র একটুখানি দাগ, হছদিন পরেই 
মিলিয়ে ধাবে ? 


১১২ 


ঠিক কী বলতে চায় সিতাংশু জানে না। কেবল অর্থহীন 
মনোধন্ত্রণার পীড়ন | ভূতের মতো ভাঁবনাট! তার উপর চেপে বসেছে, 
নিজেকে কিছুতেই ছাড়াতে পারে না তার হাত থেকে । 

কিস্তু শেষ পর্যস্ত বুলুও এল । 

আজও ঠিক তেমনি উত্তপ্ত সন্ধ্যা। লগ্টনের আলোয় নিজের 
বিকৃত ছায়! দেখতে দেখতে খেপে গিয়ে সিতাংশু বাতিট! নিবিয়ে 
দিয়েছিল। তার পর ইজিচেয়ার পেতে চুপ করে বসে ছিল জানলার 
কাছে__বাইরে কম্কালের মতো দাড়িয়ে ছিল বক্ধলবিহীন ইউক্যালি- 
পটাসের সারি--যেন কোন নিবস্ত চিতা থেকে উঠে আস! বাতাস 
ঝরঝরিয়ে তাদের পাত ঝরাচ্ছিল। 

আসব ? 

দরজার ফ্রেমে একটি মেয়ের ছায়াশরীর । সিতাংশুর সমস্ত 
সত্তা একটা নিঃশব্দ চিৎকারে ভরে উঠল। বুলু! বুলু ছাড়া আর 
কেউ নয়--কেউ হতেই পারে না। তবু জিজ্ঞাস করলে, কে? 

আমি বুলু। একটা চাঁপা হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল, 
আপনার জল চুরি করতে এসেছিলুম । 

আর লজ্জা দেবেন না। উদগ্র আহ্বানে সিতাংশুর শিরাগুলো 
টান-টান হয়ে উঠল, বন্থুন, আলোট। জ্বালি। 

আলো জ্বালবার দরকার নেই--খামকা রাস্তার লোকের 
চোখে পড়বে । শুধু একটা কথা বলতে এলুম । বলেই চলে যাব । 

চেষ্টা করেও সিতাংশু গলার কীপন থামাতে পারল না। 
বললে, কিন্তু আপনাকে আমারও বলবার কিছু আছে। সেদিন 
যে অন্তায় আমি করে ফেলেছি-_ 

অন্তায় আপনি করেন নি। আমার যা পাওনা তাইই পেয়েছি। 
আমি সত্যি সত্যিই চোর । 

ছিঃ ছি১ কী যে বলেন। আবছা অন্ধকারেও হাত জোড় 
করল সিতাংশু £ আপনি জানেন না, আমি যে সেই থেকে 
কী লঙ্জায়-_ 

৯৯১৩ 


দজাক্পি গাঁয়ে হেলান দিয়ে দাড়ালো ছায়াব্পিসী বুলু । যেন 
অনেক দৃক থেকে, অথচ স্পষ্ট সুরেলা গলায় বললে, আগে 
আমার কয়েকটা কথা শুস্থন--তার পরে লজ্জা পাবেন। আমি 
আজ আপনার কাছে কেন এসেছি জানেন? আমার মাথা 
ফাটিয়ে দ্বিয়ে যে হুঃখ আপনি পেয়েছেন, সেই ছুঃখ থেকে 
আপনাকে মুক্তি দেব বলে। তাছাড়া কাল আমি চলে যাব এখান 
থেকে--যাওয়ার আগে আপনাকে সামনে রেখে নিজের কথাঞচলে। 
বলে যাব। ইচ্ছে হলে শুনতে পারেন, না-ও শুনতে পারেন । 
আস্তে আস্তে এগিয়ে টেবিলের পাশটিতে বসে পড়ল বুলু। 

আর কেমন থমকে গেল সিতাংশু, মুহুর্তে বুলু যেন তাকে 
অনেকখানি দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। বিহ্বলভাবে বললে, 
আপনি থে কী বলছেন, আমি-- 

এখুনি বুঝতে পারবেন । আপনার হদারা থেকে ছু বালতি 
জল নিতে এসেছিলুম, সেটা বড় কথা নয়। শুনুন, আমি চোর 
হয়েই জন্মেছি । হাতের সামনে কোনও জিনিস দেখলে আমি 
আর লোভ সামলাভে পারি না। সে টাক হোক, পেন্সিল হোক, 
একট ফুলই হোক। ছেলেবেল। থেকে পাড়ার কোনও মেয়ে 
আমার সঙ্গে খেলত না--কোনও বাড়িতে ঢুকলেই আমাকে 
তারা তাড়িয়ে দিত। মেয়েদের বই খাতা চুরির জন্যে ইস্কুল 
থেকে বার বার আমাকে ওয়ানিং দিয়েছে--শেষে অসহা হয়ে 
বিদায় করেছে । আমার ছু" বছর বয়েসে মা মারা যান দেবীর 
মতো! পবিত্র ছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন স্কুলের হেড়মাস্টার-_- 
সার। জীবন সততারই সাধনা করেছেন । অথচ আমি-_ 

বুলু থামল, কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে গলা। সাম্বনা দেওয়া 
উচিত ছিল সিতাংশুর, ভাষ খুঁজে পেল ন]। 

বুলু বলে চলল, দশ বছর বয়সে বাবা আমায় ছেড়ে গেলেন, 
এলুম কাকার কাছে। কাকা আমার স্বভাব বদলাবার অনেক 
চেষ্টা করেছেন, চাবুক দিয়ে মেরেছেন, "সারা পিঠে আমার 


৯১৪ 


দাগ পড়ে গিয়েছে, অথচ কিছুতেই আমি পান্সি না। না খেতে 
দিয়ে ঘরে বন্ধ করে রেখেছেন, বেরিয়েই আমি তখুনি ফিরিওলার 
ঝুড়ি থেকে কমলালেবু চুরি করেছি । 

সিতাংশ্ড একট! অস্ফুট আর্তনাদ করল। বুলু উঠে দাড়ালো 
সরে গিয়ে সিলুয়েত. ছবির মতো ঠাই নিলে দরজার ফ্রেমে । 

ভয় পাচ্ছেন, ন1? কাল্নামেশানো হাসির আওয়াজ এল 
বুলুর, সত্যি ভয় আপনি পেতে পারেন। আমি এক্ষুনি আপনার 
টেবিল থেকে ঘড়ি কিংবা কলম যা হোক একটা তুলে নিতে পারি । 
হাত আমার এমনি রপ্ত হয়ে গেছে যে, আপনি টেরও পাবেন ন1। 

নার্ভাসভাবে গলাটা! একবার পরিক্ষার করে নিলে সিতাংগ। 
ছেলেমানুষের মতো। বললে, কিন্তু আমি তবৃও-_-কিছুতেই-_ 

বিশ্বাস করতে পারেন নান! ? অনেকেই পারে না। ভালো 
করে আমাকে যদি দেখেন আপনি, স্বীকার করবেন আমি সুন্দরী । 
রূপটা আমার গুড় কণ্াক্টের সার্টিফিকেট । কিন্তু আমাকে 
যারা চিনেছে, তারা কখনও ভূল করবে না। 

সিতাংশু আবার গলাটা পরিষ্কার করে নিলে। কিন্ত এবার 
আর কথা বেরুল ন1 মুখ দিয়ে । 

বুলু বলে চলল, আমি জানি--এ আমার রোগ। কাকাকে 
কতবার বলেছি, আমার চিকিৎসা করাও--আমি সেরে যাব, 
এ আমি আর সইতে পারছি না। কাকা বলেন, মারই হচ্ছে 
এরোগের ওষুধ । তোর বিয়ে দিতে পারব বলে আশা নেই, 
তবে কোনোদিন যদি দিতেই পারি, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বেশ করে 
ঠ্যাঙানি খেলেই রোগ পালাতে পথ পাবে না। 

আচ্ছন্নভাবে বসে রইল সিতাংশু। বাইরে মাঠের ভিতর 
থেকে হাওয়ার গোডানি ভেসে এল । 

বাইশ বছর বয়স হল আমার, এ-ন্ত্রণা আমি আর বইতে 
পারব না। তাই ভেবেছি, কাল ভোরের ট্রেনে কলকাতায় চলে 
যাব। কাকা যেতে দেবেন মা, টাকাও দেবেন না, পালিয়েই 


১৯১৫ 


যেতে হৈ আমাকে । গিয়ে আমি ডাক্তার দেখাব, ভালো হতে, 
বাঁচতে চেষ্টা করব । শুধু যাওয়ার আগে আপনাকে বলতে এসেছি, 
অন্যায় আপনি কক্পেননি, চোরকে তার পাঁওন। শাস্তিই দিয়েছিলেন । 

পরক্ষণেই দরজার ফ্রেম থেকে মিলিয়ে গেল বুলু। একট! 
লঘু পায়ের শব্দ নেমে গেল অন্ধকারে । 

স্বপ্ন--মীয়া_-মতিভ্রম ? চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে চেষ্টা 
করল লিতাংশু--পারল না, কিছুতেই পারল না। কে যেন 
হিপনটাইজ করে তাঁকে নিশ্চল স্থবিরে পরিণত করে দিয়েছে । 

একটা দমকা হাওয়ায় ইউক্যালিপটাসের কয়েকটা ঝর! পাত 
এসে সিভাংজ্ঞর গায়ে মাথায় ছভিয়ে পড়ল। 


সিতাংশুর ঘোর ভাঁঙল পরদিন । 

আজ আর উজ্জ্লস্ত সকাল নয়। এতদিনের অগ্নিদহনের পর 
পৃথিবীর প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে--আকাশ মেঘে অন্ধকার-_-বায়ু 
বহত পুরবৈয়। |” বিমবিম বৃষ্টি নেমেছে বাইরে । নামুক-_ 
আকাশ উজাড় করে নেমে আন্মক। মরা মাটিতে নতুন অন্কুর 
মাথা তুলুক-__শুকনে! ইদারাগুলো জলে ভরে উঠুক, আর বুলু-_ 

আর বুলু । স্বপ্ন-_নায়া মতিভ্রম | একট? অবিশ্বাস্য কাহিনী । 
বিচিত্র বিকৃতির নাগপাশে পাকে পাকে জড়ানো তিলে তিলে মরে 
যাচ্ছে সে। আজ সকালের ট্রেনেই তাঁর কলকাতা পালিয়ে যাওয়ার 
কথা। বাঁচুক-_বেঁচে উঠুর বুলু। প্রার্থনার মতে উচ্চারণ করল 
সিতাংশু £ এই বন্ধন থেকে সে মুক্তি পাক-_-এই অভিশাপের 
গণ্ডী পার হয়ে সূর্যন্নাত জীবনের মধ্যে তার উত্তরণ ঘটুক। 

ভয় পাচ্ছেন জানেন, এক্ষনি আপনার টেবিল থেকে 
ঘড়ি, কলম--_যাণহোক কিছু-_ 

কথাট1 কানের মধো বেজে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের 
দিকে ভাকাঁল সিতাংশু। ঘড়ি, কলম, চশমা, সব ঠিক আছে। 
কিন্ত ব্যাগ? মানিব্যাগট। ? 


১১৬ 


কালকে পাওয়া মাইনের ছু'শ পঁচিশ টাকা আছে ব্যাগে? 
পুরে হ'শ পঁচিশ টাকা । একটা পয়সাও খরচ হয় নি। 

পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিল সিতাংশু। নেই। টেবিলের 
টানায়? সেখানেও নেই । না_বালিশের নিচেও না। | 

মুহুর্তে চোখে অন্ধকার । একটু আগেকার প্রার্থনা বীতৎস 
অভিসম্পাত হয়ে এগিয়ে এল গলায় । হিপনটিজ মই বটে। সেই 
জন্যে বুলু আলো জ্বালাতে বারণ করেছিল আর উত্তপ্ত বিচিত্র 
সন্ধ্যার বিহ্বলতার সুযোগে সিতাংশুর নির্বোধ আচ্ছন্নতাকে আরও 
ঘনীভূত করে দিয়ে ব্যাগটা তুলে নিয়ে সে সরে পড়েছে। 

সিতাংশু ছুটল বিরাজবাবুর বাসায় । 

শুধু আপনার ব্যাগ নিয়েছে? জান্তব চিৎকারে বিরাজবাবু 
ফেটে পড়লেন £ আমার কী সর্বনাশ করেছে জানেন ? গিন্নীর চার 
'ভরির হার-_ছ" গাছ। চুড়ি-_সব নিয়ে শেষ রাত্রে সরে পড়েছে । 

ংশয়ের শেষটুকুও মুছে গেল। 

কী করা যায় বিরাজবাবু ? 

থানায় চলুন_-আর কী করবার আছে? বেঁটে ভারী চেহারার 
বিরাজবাবুকে নরখাদকের মতে! দেখাতে লাগল : ক্রিমিহ্যাল মশাই 
_বর্ন ক্রিমিম্তাল! ওই লজ্জাতেই দাদ অসময়ে মার! গেলেন। 
বিস্তর শাসন করেছি মশাই, চাবকে চামড়া তুলে দিয়েছি, দেওয়ালে 
ঠুকে ঠুকে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি, তবু স্বভাব ছাড়ানো! গেল না। 
মেয়েছেলে, তায় আমাদের বংশের-_কী করে যে এমন হল ভাবতেই 
পারা যায় না। চলুন থানায়, ও-মেয়ের জেলখাটাই দরকার । 

ঘরের ভিতর বিরাঁজবাবুর স্ত্রীর ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না ঃ হ্ধ 
দিয়ে আমি কাল সাপ পুষেছিলুম-_আমার সর্ধনীশ করে গেল-_ 

বিরাজবাবু আরও খেপে গেলেন। হাত ধরে টানতে লাগলেন 
সিতাংশুর । 

চলুন, চলুন, আর দেরি করবেন না। এখনও বোধহয় 
জসিডি পেরুতে পারে নি। 


১১৭ 


বুলু ফিরল সন্ধ্যের পর। পুলিস তাকে ফিরিয়ে এনেছে 
আসানসোল থেকে। 

কিন্তু ততক্ষণে সিতাংশ্ুর মনের আগুনটা নিবে গিয়েছে । 
সার! দিনের অশ্রাস্ত বৃষ্টিতে পৃথিবীর মাটি জিগ্ধ হয়েছে, সুগন্ধ- 
শীতল ভিজে বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিয়েছে । আর চুপচাপ বসে 
বসে লিগা ভাবছিল, কী দরকার ছিল ছু'শ পঁচিশ টাকার 
জন্যে অতথানি পাগলামি করবার ? বাড়ি থেকে টাকা আনিয়ে 
যাহোক করে এমাসটা তার চলে যেত, কিছু ধারও হয়ত হত, 
সেটা শোধ দেওয়া যেত আস্তে আন্তে। কেন সে করতে গেল 
এসব? হয়ত বুলু সত্যিই যাবে সাইকোলজিস্টের কাছে, এই 
টাকাট। দিয়ে নিজের চিকিৎসা করাবে, সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর 
হয়ে উঠবে। বুলুকে মেরে যে পাপ করেছিল--এই টাকায় তার 
প্রায়শ্চিত্ত হবে খানিকটা । কেন এতট! হীন হয়ে গেল সিতাংশু, 
কালকের সেই অভিশপ্ত বুলুকে সে ভূলে গেল কী করে? 

এমন সময় প্রায় নাচতে নাচতে এলেন বিরাজবাবু। 

চলুন, চলুন । শ্রীমতী পৌঁছেছেন । 

ধড়ফড় করে উঠে বসল সিতাংশু, কোথায় ? 

হাজতে। 

বুকের ভিতর হাতুড়ি পড়ল একটা । কালো হয়ে গেল মুখ । 

মাপ করবেন, আমি পারব না। 

পারবেন না! কি? যেতেই হবে। খবর পাঠিয়েছে থানা থেকে । 

আমার শরীর খারাপ । 

নিষ্ঠুর হাসি হাসলেন বিরাজবাবু। 

আপনি ইয়ং ম্যান, ওসব সেট্টিমেন্ট আমি বুঝি । কিন্তু আমার 
অনেক বয়েস হয়েছে মশাই | উঠ্‌ন- চলুন শিগগির-_ 

একটা মৃতদেহের মতো সিতাংশুকে টেনে তুললেন রিকশায় । 
তাঁর পর থানাতে। 


১৯৮ 


খানান্ুত্ধ লোকের কৌতুক-ভর! চোখের সামনে একটা টুলে, 
বসে আছে বুলু। রুক্ষ চুল, ভাষাহীন চোখ । সামনের দেওয়াজের 
দিকে স্থিরদৃষ্টি। আজ সারাদিন সে সান করে নি, খেতে পায় নি। 

চোরের মতো একবার বুলু দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ পিছনে 
সরে গেল সিতাংশু, লুকিয়ে পড়তে চাইল। এইবার বুলুকে সে 
সম্পুর্ণ দেখছে--দেখছে কপাল্সে এক ইঞ্চি লম্বা কাট। দাগট! এখনও, 
শুকোয় নি। সিতাংশুর স্বাক্ষর | 

কিন্তু সম্পূর্ণ কি দেখেছে সিতাংশু 1 না" দেখবার সাহস নেই। 
সাহস নেই, বুলুর আরক্ত ভাষাহীন চোখের দিকে সে তাকায়। 

দারোগা! বললেন, এই দেখুন গয়না । হার, চুড়ি-_ 

বিরাজবাবু প্রায় ঝাপিয়ে পড়তে চাইলেন সেগুলোর ওপর । 
বললেন, হ্থ্যা, হ্্যা--এ সবই আমার ক্র 

বুলু কথ! বললে এইবার । সেই শাস্ত, সুরেলা গল।। যেন 
অনেক দুর থেকে ভেসে আসছে । 

না, কাকীমার গয়না আমি নিই নি! ওসব আমার মায়ের 
জিনিস। কাকীমার কাছে ছিল। 

মায়ের জিনিস! বীভৎসভাবে বিরাজবাবু ভেংচে উঠলেন £ 
 চৌপরাও হারামজাদী | চোর ! 

বুলু আবার শাস্ত গলায় বললে, আমি জানি--ও সবই আমার 
মায়ের । কাকীমার কোনও জিনিসই আমি ছু'ই নি। 

বিরাজবাবু বুলুর উদ্দেশে প্রকাণ্ড একট! চড় তুলেছিলেন, 
দারোগা তাকে ধমক দিলেন, থাযুন, আপনার শ্রী এসে গয়ন! 
সনাক্ত করবেন, আপনি গণ্ডগোল করবেন;না। তার পর সিতাংশুর 
দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, শ'খানেক ক্যাশ টাক! পেয়েছি, 
কিন্তু আপনার ব্যাগ পাওয়া যায় নি। 

বিরাজবাবু বললেন, ব্যাগটা রেখে দেবে--ওকি অমন কীচ৷ 
চোর নাকি? আপনি ওকে চেনেন না সার--ও যে 

আঃ--দারোগ! আবার ধমক দিলেন একট! । 


১৯৫১ 


বুলুর্‌ উদাস বিষ বর শোনা গেল £ আমি ওঁর ব্যাগ নিই নি। 
'আমার নিজের চুড়ি বিক্রি করে” 

বিরা্গবাবু আবার ভেংচে উঠলেন, ওরে আমার সত্যবাদী 
যুধিটির রে! নিজের চুড়ি বেচে উনি-_ 

আর নয়। এর পরে আর কোনোমতেই দাড়ানো চলে ন1। 
চোরের মতো নিঃশবে পালিয়ে এল সিতাংশু । শুধু পথে আসতে 
আসতে বার বার মনে হল £ আজ সারাদিন বুলুর খাওয়। হয় নি। 

ব্যাগট!। কিন্তু পাওয়া গেল। অফিসের ড্রয়ারেই রেখে এসেছিল। 

এ-সন্দেহও সিতাংশুর মনে জাগতে পারত । কিন্তু সন্ধ্যায় 
এসে যদ্দি এমনভাবে নিজের কথ! না বলত বুলু, যদি বিরাজবাবুর 
বাড়ি থেকে গয়নাগুলে! সে না নিত, যদি সত্যিই সে কলকাতায় 
পালাতে ন1 চাইত, তা হলে__ 

ব্যাগটাকে তৎক্ষণাৎ পকেটে লুকিয়ে ফেলল সিতাংশু। এখন 
থানায় যাঁওয়1 যায় ? বলা যায়, বুলু তার টাঁক1 নেয় নি ?ভূল করে 
সে মিথ্যে এজাহার দিয়েছিল ? 

কিন্ত আরকি সম্ভব? তাতে নিজের উপরেই বিপদ টেনে 
আনা হবে । কেন তুমি এমন কাজ করলে 1? কেন একজন নিদে্ণষকে 
মিথ্যে নালিশ করে-_ 

নাঃ সে মনের জোর নেই সিতাংশুর । তাছাড়া এই হয়ত ভালো 
হল। জেলেই যাক বুলু। পাক ছুঃখ, পাক লজ্জা । হয়ত এ 
থেকেই বুলু ভালে! হয়ে উঠবে; যে সহজ স্বাভাবিক সুন্দর জীবনের 
মধ্যে সে যেতে চেয়েছিল, হয়ত তারই প্রস্তুতি হবে এখান থেকে । 

বাইরে বৃষ্টি। দগ্ধ মাঠে নতুন অন্কুর। ইদারায় নতুন জল। 
বুলুর চোখেও কি বর্ষা নেমেছে এখন ? 

আকাশ চিরে বিহ্যুৎ চমকাল। একটা রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্থের মতে।। 
আর তখনই দেখতে পেল দসিতাংশু। বুলুর জীবনের দিগ-দিগস্ত 
জুড়ে অমনি একটা ক্ষতের স্বাক্ষর একে দিয়েছে সে। 


২৪ 


করাত 

যদিও সবটাই ম্যাজিক, তবু দৃশ্টট! সইতে পারে না অরুণা।. 
উজ্জ্বল আলোর বৈহ্যুতিক করাতের সেই হিংস্র দাতগুলো! যেন তারই 
বুকের ওপরে কেটে কেটে বসতে লাগল । এমন একটা বিশ্রী 
জিনিস ন। দেখালে কী ক্ষতি হয়? 

সোমেন অত্যন্ত খুশি হয়ে বললে, বাঃ-বাঃ ! 

অরুণা চোখ বুজে ফেলেছিল, সোমেনের গলার স্বরে চমকে 
ফিরে তাকাল তার মুখের দিকে । স্টেজের উজ্জ্বল আলোয় অন্ধকার 
অডিটোরিয়ামে একট নীলাভ ছায়! ছড়িয়ে পড়েছে । সোমেনের 
ধারালে! নাক-মুখ সেই ছায়ায় অদ্ভুত রকম তীক্ষ রেখাস্থিত হয়ে 
উঠেছে, আর ধকধক করে জলছে তার চোখ। মুহুর্তে শিউরে উঠল 
অরুণা--স্টেজের বীভৎস দৃশ্যটার চাইতেও নিজের স্বামীকে তার 
আরও বীভৎস বলে মনে হল। 

সভয়ে আবার চোখ বুজল অরুণ । 

এর আগে চোখের সামনে যাত্রীম্ুদ্ধ মোটর গাড়ি অবশ্য 
হয়েছে আরও অনেক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেছে। মুগ্ধ হয়ে 
দেখেছে অরুণা, উচ্ছৃসিত হয়ে হাততালি দিয়েছে । কিন্তু বৈদ্যুতিক 
করাতের খেলাটা সে কিছুতেই সহা করতে পারছে না। হাঙরের 
দাতের মতো সারি সারি ইস্পাতের দত ষেন কেটে কেটে বসছে তার 
বুকের ওপর । আর-আর সোমেনের মুখ। অভিটোরিয়ামের 
নীলিম ছায়ায় সে মুখ যে এমন বীভৎস দেখাতে পারে অরুণা এর 
আগে তা কল্পনাও করতে পারে নি। 

আবার চোখ বুজল সে। চোখের পাতা ছুটোকে চেপে ধরতে 
চাইল প্রাণপণে। 

উত্কট আনন্দে যেন ধরাতে দাত ঘষছে সোমেন । তার উত্তেজিত 
ভ্রুত নিশ্বাসের শব্দ পর্যস্ত শুনতে পাচ্ছে অরুণা। কেমন অবরুদ্ধ 
গলায় সোমেন বললে, ইউনিক। ৰ 


৮ ৯২৯ 


অরুণার মাথার ভেতর সব কেমন ধোঁয়াধোয়া হয়ে আসতে 
চাইিল। এ্রয়ার-কপ্তিশন্ড ঘরে একট দম-আটকানে। ভাব, এতগুলো 
মানুষের নিশ্বাস-প্রশ্বাসে কোথাও বুবি একটুকুও অক্সিজেন আর 
অবশিষ্ট নেই। স্তন্ধ বাতাসটাকে আরও ভারাক্রান্ত করে তুলেছে 
প্রসাধনের গন্ধ, চুলের গন্ধ, বাক্স থেকে সগ্-যুক্তি-পাওয়। শাড়ির 
ম্যাপথলিনের গন্ধ। অরুণার সমস্ত চেতন! কেমন ঘেন আবিষ্ট 
হয়ে এল। 

ওধু সোমেনের মুখটা সে ভুলতে পারছে না। কয়েকটা অদ্ভুত 
কঠিন রেখার ওপর জবলস্ত চোখ । কপালে কয়েক বিন্দু ঘাম নিয়ে 
বসে অরুণ। ভাবতে লাগল, ছেলেবেলায় দেওঘরের একট অভিজ্ঞতার 
কথা । বিকেলে বেড়াতে বেড়াতে পুরনো পোড়ো মতন একটা 
বাড়িতে কী যেন খেয়ালে ঢুকে পড়েছিল সে। গেটের পাশেই 
গ্যারাজের মতো। একটা অন্ধকার ঘর । সেই ঘরে উঁকি দিয়ে অরুণ 
দেখেছিল, তার কোনায় সোমেনের মুখের মতোই কঠিন রেখ দিয়ে 
গড়া কী একটা চুপ করে বসে আছে, তার কালো শরীরের স্পষ্ট 
কোনো রূপ বোঝা যায় না, শুধু ছুটো। শীতল চোখ অকণার দিকে এক 
ভাবে চেয়ে রয়েছে, স্থির হয়ে আছে ছু” টুকরো আগুন, তাতে পলক 
পড়ছে না। 

সেই বারো বছর বয়সেও অরুণা বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে 
পেরেছিল, ওই চোখে এমন একটা নিলজ্জ হিংস্রতা আছে, যা এর 
আগে কোথাও সে কোনোদিন দেখে নি। ও চোখ মানুষের নয় । 

চিৎকার করে সে ছুটে পালিয়ে এসেছিল। লুকিয়ে পোড়ো 
বাড়িতে যাওয়ার কথ! কাউকে সে বলতে পারে নি, ওই চোখ ছটোর 
কথাও না । হয়তো৷ বিশেষ কিছুই নয়, হয়তো! একটা কুকুর বসে 
ছিল, কিন্তু তার পর অনেক বার স্বপ্নের মধ্যে ওই হিংআ অপলক 
দৃষ্টিট। অমানুষিক ভয়ে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। 

কিন্ত সোমেনের চোখ ছুটে! অমন দেখাচ্ছে কেন? সোমেন 
তার স্বামী। কেন ভয় পাচ্ছে অরুণ! ? 


১২২ 


প্রচণ্ড করতালির শব্দে ঘোর ভাঙল তার। জেগে উঠে দেখল, 
ম্যাজিক শেষ হয়ে গেছে, আলোয় ঝকমক করছে অডিটোরিয়াম 
আর উঠে দীড়িয়েছে সোমেন। তার স্বামী। সুদর্শন, শিক্ষিত, 
ভদ্রলৌক। যেস্বামী তার আপন, তার আশ্রয়--যাকে তার ভয় 
করবার কোনে! কারণই নেই। 

সোমেন বললে, চল, যাওয়া যাক। 

অরুণ বেরিয়ে এল নিঃশব্দে । আঃ বাইরের আকাশটা কত 
বড়! 

রাস্তায় এসে ট্যাক্সি ডাকল সোমেন। গাড়িতে উঠে বললে, 
ময়দান চলিয়ে । 

বাড়ি ফিরবে না? 

অরুণ আশ্চর্য হল। 

একটু মাঠে বেড়িয়ে যাই । মাথাটা ধরেছে। হাত-ঘড়ির দিকে 
তাকিয়ে সৌমেন বললে, রাত তো এখনও বেশি হয় নি। 

অরুণা ভাবল, কথাট' তারই বল! উচিত ছিল। ওই দম-আট- 
কানো ঘরের ভেতর, শাড়ি, প্রসাধন আর মানুষের গায়ের গন্ধে, 
স্টেজের ওপর ওই দানবিক প্রক্রিয়াটায় আর সোমেনের জ্বলস্ত 
দৃষ্টিতে তারও মাথায় একটা! চাপা যন্ত্রণা আরম্ভ হয়েছে, এতক্ষণে 
সেটা যেন অনুভব করল সে। একটু বেড়ানে৷ তারই দরকার। 

গাড়ি চলল । 

ছাড়া-ছাড়া আলে! আর গাছের ছায়ায় অন্ধকার । কেমন 
অপরিচিত মনে হয় সব। বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল 
অরুণ । কী একটা বুঝতে চেষ্টা করছে, ঠিক বুঝতে পারছে ন1। 
রেসকোর্সের মাঠটাকে একট! বিশাল ভূভুড়ে স্টেজের মতো দেখাচ্ছে 
আরও রাত হলে, আলোগুলোর রঙ আরও ঘন হয়ে উঠলে, মাঠের 
গাছপালায়, নিবিড় ঘাসের ওপর অন্ধকার একরাশ কালে! আঠার 
মতো জড়িয়ে গেলে, এই রেসকোর্সের মাঠেও হয়তে। এমনি একট! 
অলৌকিক ম্যাজিকের আসর বসবে । একটা বিরাট করাত দাঁতে 


১২৩ 


দাঁতে ঘববার বিকট আওয়াজ তুলে কী যেন কেটে চলবে সমানে, 
আর নিউ রাইটার্স বিল্ডিয়ের ওপরের আলোট! ভয়ঙ্কর নিনিমেষ 
দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে থাকবে সোমেনের মতো! । অবশ্য 
সোমেনের যদি একটামাত্র চোখ থাকত । 

অরুণার ভয় করতে লাগল । এই আলো, গাছের ছায়া, প্রায় 
অবাস্তব ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, প্রতীক্ষমান কালপুরুষের মতো 
কয়েকটা স্ট্যাহ, পাঁশে বসে-থাকা মোমেনের সিগারেটের আগুন-_ 
সব মিলিয়ে অরুণার অতান্ত খারাপ লাগতে লাগল । 

হঠাৎ সোমেন কথ? বললে £ ওই গাছ তিনটে দেখতে পাচ্ছ ? ওই 
যে একসঙ্গে সার দিয়ে দাড়িয়ে আছে? 

দেখতে পেয়েছে বই কি অরুণাঁ। খুব সম্ভব আমগাছ। বিচিত্র 
ভঙ্গিতে পাঁশাপাশি দাড়িয়ে--যেন তিনটে ঝাকড়া মাথ! চুপি চুপি 
কী একট কুটিল পরামর্শ করে চলেছে। রাত্রে সব জিনিসের 
চেহারাই কী ভাবে যে বদলে যায়! 

দিন পনরো! আগে, ওখানে_| সোমেন সিগারেটে একটা টান 
দিলে, খানিক লালের আভ। ছড়িয়ে পড়ল তার মুখে £ ওখানে খুন 
হয়ে গেছে । হরিব্ল্‌ ব্যাপার একট1। 

অরুণ! অস্ফুট শব্দ করল। নিঃশব্দ হাঁসি হেসে গাছ তিনটে 
যেন ছিটকে সরে গেল পেছনে । 

সোমেন বললে, আমি ট্যাক্সি করে ভবানীপুর যাচ্ছিলুম, ওখানে 
একটা ছোট ভিভ দেখে নেমে পড়লুম একবার । কাছে গিয়ে দেখি, 
একজন পশ্চিম! মুসলমান । গলার অধেকিটা কাটা, চারপাশের 
মাটি রক্তে লাল, জীষটে গন্ধ, মাছি উড়ছে । 

অরুণা আর সহা করতে পারল না। প্রায় চিৎকার করে উঠল £ 
আং-_থামো ! কী বকছ তুমি! 

সোমেন অল্প একটু হাসল । সিগারেটট। ছুড়ে দিলে বাইরে । 
বললে, মেয়ের! ভারি সেন্টিমেপ্টাল হয়। এতেই ভয় পেলে? তকু 
তো! চোখে দেখ নি। 


১২৪ 


গাঁড়ি চলেছে। ছায়া আর আলো, মান আলো! আর অন্ধকার । 
গাড়ি পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়েছে । এক পাশে গাছের সারির 
ও-ধারে রাত্রির গঙ্গা । একটা জাহাজে অসংখ্য আলো জেটিতে: 
মানুষের ভিড়। কোনও একটা অনুষ্ঠান আছে ওখানে । ময়দানের 
বিভীষঘিক। পার হয়ে এতক্ষণে যেন একট স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে 
পা দিয়েছে অরুণা। শুধু ভয় নয়, সেই সঙ্গে একরাশ তীব্র দ্বৃণায় 
তার গ! গুলিয়ে আসতে লাগল । গলার অধেকটা কাটা রক্তে 
লাল, জষটে গন্ধ, মাছি উড়ছে-_উঃ ! 

কী দরকার ছিল সোমেনের ? কী দরকার ছিল জিনিসট এমন 
বীভতসভাবে তাঁকে শোনাবার ? 

বাড়ি চল, আমার শরীর খারাপ লাগছে । 

সোমেন আবার সিগারেট ধরাল। চেন-সম্মোকারের মতো ঘন 
ঘন সিগারেট খাচ্ছে আজ । 

আবার ওই পথ দিয়েই ঘুরে যাব 1 জায়গাটা দেখবে ভালো 
করে ? সত্যি, ওই রকম জায়গাতেই খুন করবার-- 

কী পাগলামি করছ তুমি !--ভয়ে বিস্ময়ে অরুণার হৃৎপিণ্ড থমকে 
যেতে চাইল £ মানে কী এ-সবের ? 

বলেই সে সোমেনের দিকে তাকিয়ে দেখল । ঠিক যেন পুনরাবৃত্তি 
ঘটেছে একটা । সেই নীলাভ আলো, সেই প্রোফাইল-_- ধারালো 
মুখের রেখা, ছুটে জ্বলন্ত চোখ, আর-_আর সিগারেটের আগুনটা ! 
একটা তৃতীয় নেত্রের মতো জ্বলছে যেন। 

তৃতীয় নেত্রই বটে। অরুণা সন্ত্রস্ত আর্ত গলায় বললে, ফেলে 
দাও সিগারেটটা, ফেলে দাও এক্ষুনি ! 

কেন? 

ফেলে দাও বলছি, শিগগির ফেলে দাও । 

আশ্চর্য ! মেয়েদের মনস্তত্ব ভারি বিচিত্র !--০সামেন সিগারেটটা 
ফেলে দিলে না বটে, কিন্ত তখনই ট্যাক্সির আযশট্রেতে মুখ ঘষে 
নিবিয়ে ফেলল । 


৯৫ 


সীটের গায়ে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে অন্ধ চোখে আর বদ্ধ 
গলায় অক্রণা বললে, বাড়ি ফিরে চল। আমার একদম ভালে! 
লাগছে না । 


বেশ, চল তবে । সর্দারজী, কালীঘাট | 


দোতলার বারান্দায় একটা ইঈজি-চেয়ার টেনে চুপ করে শুয়ে 
ছিল সোমেন। রাত এগারোটার কাছাকাছি । অরুণ পাশে 
এসে দাড়ালো । 

বসে আছ যে এখনও ? খাবে না? 

একটু পরে ।- সোমেন চেয়ারের ওপর পিঠ সোজা করে উঠে 
বসল। হঠাঁ বেখাগ্পা প্রশ্ন করল একটা £ অনুপম সেনের সঙ্গে 
তোমার দেখা হয় আজকাল ? 

চমকে উঠল অরুণা। মুহুর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল মুখ । বারান্দার 
এদ্িকের আলোটা নেবানো। অরুণাকে ভালে! করে দেখতে পেল 
না সোমেন, কিন্তু তার মুখের রঙ বদলানে। জানতে বাকি ছিল না 
তার। বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে অরুণ। বুকের স্পন্দনটাকে শাস্ত 
করতে চেষ্টা করল। সোমেন কি কিছুতেই ভুলতে দেবে না ? 

আবার ও-কথা কেন তুলছ তুমি? মেতে! আট বছর আগে- 
কার ব্যাপার । 

এমনি । প্রায়ই মনে হয় ।--সোমেন মুছু হাসল প্রথম প্রেম 
কিনা, তাই আট বছরেও বোধ হয় তাকে ভোল। যায় ন।। 

ছিঃ ছিঃ, এসব তোমার মিথ্যে সন্দেহ । অনুপমদ। আমাকে গান 
শেখাতেন। তার বেশি কিছুই নয়। কেন একটা বাজে কথা তুলে 
আমাকে কষ্ট দাও বার বার-_নিজেও কষ্ট পাও ? 

বাজে কথা, না? সোমেন আবার হাসল | কিন্তু হাসির শব্দটা 
এবারে ধ্াতে দাতে ঘষ। একটা বিশ্রী আওয়াজের মতো। শোনালো । 

বাজে কথ। বই কি। অন্থুপমদা আমাকে গান শেখাতেন, নেহ 
করতেন । 


৯২৬ 


স্েহ করতেন নিশ্চয় !-"সোমেন আস্তে আন্কে বললে, কালকেই 
তোমার পুরনে। একটা গানের খাতা দেখছিলুম ৷ ভাতে এক জায়গায় 
অনুপম সেনের নাম লেখা আছে। তার ওপর তুমি লিখেছ ১ আমার 
জীবনপাত্র উচ্ছলিয়।-- 

অরুণ তীব্র গলায় বললে, কেন তুমি যখন-তখন আমার খাতা 
আর বইপত্র নাড়াচড়। করো, আর সব জিনিসের যা-তা মানে করে 
বাজে একটা কমপ্লেক্সে কষ্ট পাও ? আজ আট বছর ধরে-_ 

সোমেন ক্রুর গলায় বললে, শুধু আট বছর কেন, আরও আটক্রিশ 
বছর হয়তে। আমাকে বাঁচতে হবে । হয়তো আরও বেশি। আর 
সঙ্গে বেচে থাকবে অনুপম সেন। সেই ভায়াঞ্কির কথাটাই আমি 
কিছুতে ভুলতে পারছি না। সেইটেই অসহা হয়ে উঠেছে 
অরুণ । 

আজ তোমার কী হয়েছে £--অরুণা প্রাণপণে নিজের মধ্যে 
খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করবার চেষ্টা করতে লাগল যাকে মিথ্যে 
বলে জানো 

না, মিথ্যে বলে জানি না। তাঁর চাইতেও বড় কথা, সত্য বলেও 
জানি না।__সোমেন তিক্ততম স্বরে বললে ঃ তুমি আমাকে বুঝবে 
না অরুণা। আর ন। বোঝাই বোধ হয় ভালো । 

হ্যা, না বোঝাই ভালো ।-__অরুণা আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছিল 
সেখান থেকে । সোমেন তাকে পিছু ডাকল। 

শোনো» ম্যাজিকটা কেমন দেখলে ? 

আমার ভালো লাগে নি। 

ভালে। লাগে নি? আশ্চর্য 1 সোমেন কয়েক সেকেগড স্থির 
দৃষ্টিতে অরুণার দিকে তাকিয়ে বললে £ আমার তো দারুণ ভালো 
লাগল। আর বিশেষ করে লাস্ট আইটেমট1। নুপার্ধ, থীলিং। 
কাল যাবে আর একবার ? 

শীতল কঠিন মুঠিতে কে তৎক্ষণাৎ অরুণার হৃৎপিণ্ড চেপে ধরল । 
বন্ধ হয়ে যেতে চাইল নিশ্বাস। 


৯.৭ 


না না॥ আমি যেতে পারব ন1।-- আর্তনাদ করে অরুণ বললে £ 
আমি যাব না। ইচ্ছে হলে তুমি যাও। 

পাগল! তা৷ কি হয়?--শাস্তভাবে সোমেন বললে ; তুমি 
সঙ্গে না থাকলে দেখে সুখ হবে কেন ?--একটা সিগারেট ধরাতে 
ধরাতে বললে, তার পর গড়ের মাঠে বেড়িয়ে-_ 

এক মুহুর্তে সবগুলো! জিনিস একটি অর্থ নিয়ে ধরা দিলে অরুণার 
কাছে। সেই করাত, সেই তিনটে গাছ, রক্তের গন্ধ, অনুপম সেন, 
কুটিল হিংসার অবচেতন চরিতার্থতা-_ 

শুধু স্টেজে নয়, শুধু রেসকোসে নয়-__এই ঘরে, দিনের পর দ্রিন, 
বছরের পর বছর যে করাতের তীক্ষধার দাতগুলে। জীবনকে সমানে 
কেটে চলেছে, তার হাত থেকে মুক্তি কোথায় অরুণার ? কোথায় 
পালাবে অরুণ ? 

সোমেনের সিগারেটের আগুন জ্বলতে লাগল, সেই তৃতীয় 
নেত্রের মতো । 


151010৮11৫5 01888 
2578281৭081, এ 


৩১৮০/178,